সকল মেনু

খুলনাতে আবার পলিথিনে সয়লাব !

খুলনা প্রতিনিধিঃ খুলনা জেলা ও মহানগরীতে উদ্বেগজনকহারে পলিথিনের ব্যবহার বেড়েছে। বিভিন্ন শপিং মল, কাঁচা বাজার, মুদি বাজার, হোটেল রেস্টুরেন্টসহ সর্বত্র নিষিদ্ধ পলিথিনের আধিপত্য। নগরীর রাস্তাঘাট, ড্রেন এবং জলাশয়ে ব্যবহৃত পলিথিনে স্তুপই জানান দিচ্ছে খুলনার পরিবেশ কতটা হুমকিতে রয়েছে। কিন্তু পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান পরিবেশ অধিদপ্তর নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। বছরের হাতে গোনা দু’চারটি অভিযানের মাধ্যমে তাদের কর্মকান্ড অব্যাহত রেখেছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের নিয়মিত বাজার অভিযান না হওয়ার কারণে নিষিদ্ধ পলিথিনে সয়লাব হয়ে গেছে বলে সাধারণ মানুষ মনে করছেন।
সরেজমিনে গতকাল সোমবার নগরীর বিভিন্ন বাজারে গিয়ে দেখা যায় পলিথিনের অবাধ ব্যবহার। মাছ, কাঁচা বাজার, ফল ফলাদি ও মুদির দোকানে দেদারছে চলছে পলিথিনের ব্যবহার। এ সময় দোকানীদের সাথে আলাপকালে তারা জানান, আমাদের কাছে সেলসম্যানরা এসে পলিথিন দিয়ে যায়। তাছাড়া খুলনায় বড় বাজারসহ দৌলতপুর-খালিশপুর এলাকায় পলিথিনের বেশ কয়েকটি বড় মোকাম রয়েছে বলেও জানান। ক্রেতারা জানান, বিকল্প ব্যবস্থা থাকলে পলিথিন ব্যবহার কেন করবো। সরকার যেখানে আইন করেছে সেই আইনের প্রয়োগকারী সংস্থা কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
নগরীতে কয়েক দিন ধরে পরিবেশ অধিদপ্তরের পৃথক দু’টি অভিযানে বিপুল পরিমাণ নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করা হয়। কয়েকজন ব্যবসায়ীকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে জরিমানাও করা হয়েছে। তবে অধিদপ্তরের এ সকল অভিযান ও আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে নিষিদ্ধ পলিথিন তার নিজস্ব গতিতে চলছে। গত ১৭ ডিসেম্বর নগরীর ফুলবাড়ীগেট বাজারে অভিযান চালিয়ে আড়াই টন নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দসহ দু’টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ২৫হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ ইকবাল হোসেন এ জরিমানা করেন। এছাড়া গত ১০ ডিসেম্বর নগরীর বড় বাজারের একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে নিষিদ্ধ পলিথিন উদ্ধারের প্রতিষ্ঠানের মালিকসহ দু’জনকে ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা)’র খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী মাহফুজুর রহমান মুকুল সময়ের খবরকে বলেন, বর্তমানে বাজারে খোলামলো ভাবে নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবহার উদ্বেগজনকহারে বেড়েছে। নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবহার রোধে পরিবেশ অধিদপ্তরের সিডিউলভূক্ত একটি কাজ। তারা সঠিকভাবে এবং পর্যাপ্ত অভিযানে ব্যর্থ হওয়ায় নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবহার ও মজুদকারীরা প্রকাশ্যে কেনা-বেচা করছেন। এছাড়া সাধারণ মানুষ নিষিদ্ধ এ পলিথিন যাতে ব্যবহার না করে এজন্য পরিবেশগত ক্ষতির দিক তুলে ধরে প্রচারণার অভাবকেও দায়ি করেন তিনি। এছাড়া নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে তিনি জেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপও কামনা করেছেন।
সূত্রমতে, ১৯৩৩ সালে এই পলিমার পণ্য আবিষ্কৃত হলেও ১৯৫৮ সাল থেকে ভোক্তার ক্রয়সীমানা দখল করে নেয়। পরিবেশ অধিদফতরের সূত্রমতে, ১৯৮২ সালে বাংলাদেশে পলিথিন বাজারজাত ও ব্যবহার শুরু। পলিথিন গলে না, মেশে না, পঁচে না। ৫০০ থেকে হাজার বছরে এটি আবারো প্রকৃতিতে রূপান্তরিত হয়। ১৯৯৫ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ৬(ক) (সংশোধিত ২০০২) ধারা অনুযায়ী, ২০০২ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকা শহরে এবং একই সালের ১ মার্চ বাংলাদেশে পলিথিন নিষিদ্ধ করা হয়। পলিথিন নিষিদ্ধকরণ প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, যেকোনো প্রকার পলিথিন ব্যাগ অর্থাৎ পলিথাইলিন, পলিপ্রপাইলিন বা উহার কোনো যৌগ বা মিশ্রণের তৈরি কোনো ব্যাগ, ঠোঙা বা যেকোনো ধারক যাহা কোনো সামগ্রী ক্রয়বিক্রয় বা কোনো কিছু রাখার কাজে বা বহনের কাজে ব্যবহার করা যায়, উহাদের উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রয়, বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহন বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার দেশে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হইল।’ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০০২) এর ১৫(১) অনুচ্ছেদের ৪ (ক) ধারায় পলিথিন উৎপাদন, আমদানি ও বাজারজাতের জন্য অপরাধীদের সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা ছয় মাসের কারাদণ্ডের বিধান আছে। আইন অনুযায়ী ১০০ মাইক্রোনের কম পুরুত্বের পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ। আইন অমান্যকারীর জন্য ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। বাজারজাত করলে ছয় মাসের জেল ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা।
মাঝে মধ্যে এ আইন মেনে ভ্রাম্যমাণ আদালত ‘লোক দেখানো’ কিছু জরিমানা আর অভিযান চালালেও পলিথিনের ব্যবহার থামছে না। পলিথিন যেন আইন, বিচার কাঠামো, সরকার, রাষ্ট্র সবকিছুর চেয়ে শক্তিময় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কী এক বিস্ময়কর কারণে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তর ২০০২ থেকে ২০১৭ অবধি, দীর্ঘ ১৫ বছর পলিথিনকে থামাতে ব্যর্থ হচ্ছে।
পরিবেশবিদদের ভাষ্যমতে, শহরের নদী প্রবাহগুলো পলিথিনের আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে। পলিথিন জমতে জমতে নদীর তলায় দীর্ঘ অভেদ্য স্তর পড়েছে। কোথাও এ স্তর এতই শক্ত যে, বর্ষা মৌসুমেও আটকে যাচ্ছে জলযান। পলিথিন মাছের বিচরণে বাধা দেয়। শৈবাল, অণুজীবসহ জলজ বাস্তুসংস্থান তছনছ করে ফেলে। জলের তাপমাত্রা, স্বাদ, বর্ণ, গন্ধ, বৈশিষ্ট্য সবকিছু বদলে দেয়। পলিথিন মাটিতে দ্রুত মিশতে পারে না বলে এটি মাটির অভ্যন্তরীণ খাদ্যশৃঙ্খলকে আঘাত করে। অণুজীব ও মাটিতে জন্মানো উদ্ভিদ ও প্রাণীর সহাবস্থানকে যন্ত্রণাকাতর করে তুলে। ধীরে ধীরে মাটির বৈশিষ্ট্য ও গঠনে দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন তৈরি করে। পলিথিন জমে জমে মাটির দীর্ঘ অঞ্চল শস্য-ফসল জন্মানোর অনুপযোগী করে ফেলে।
খুলনা বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তর পরিচালক মোঃ হাবিবুল হক খান এ ব্যাপারে জানান, মিলগুলোতে উৎপাদন বন্ধ না হলে শুধুমাত্র মাঠ পর্যায়ে অভিযান চালালে পলিথিনের ব্যববহার বন্ধ হবে না। তবে আগামীতে নিয়মিত অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে তিনি জানান।
এবিষয়ে জেলা প্রশাসক আমিন উল আহসান বলেন, সরকারি আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসন সব সময় অভিযান করে। তবে এবিষয়টি গুরুত্ব সহাকারে দেখা হবে বলেও জানান তিনি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top