সকল মেনু

আইন ভাঙ্গছেন ইলেকট্রনিক্স পণ্য বিপণনকারী বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান

হটনিউজ ডেস্ক: স্ক্র্যাচ কার্ড আনন্দ অফার। কার্ড ঘষলেই নিশ্চিত আকর্ষণীয় উপহার অথবা পুরোটাই ফ্রি!! দৈনিক পত্রিকায় এরকম অফার দিয়ে ফ্রিজের বিজ্ঞাপন প্রচার করছে মিনিস্টার ব্র্যান্ড। কিন্তু, ক্রেতা আকৃষ্টে ও পণ্য বিক্রি বাড়াতে অফারের নামে বিভিন্ন ধরণের উপহারের প্রলোভন দেখিয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার করা দেশের প্রচলিত আইনে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিদ্যমান আইনে জেল-জরিমানার বিধানও রয়েছে। তা সত্ত্বেও, ক্রেতা আকৃষ্টে আইন লঙ্ঘন করে ঈদ অফারের বিজ্ঞাপন প্রচার করছে মিনিস্টারসহ বেশ কয়েকটি ইলেকট্রনিক্স পণ্য বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান ও বিক্রেতা। এর মধ্যে রয়েছে মিনিস্টার, সিঙ্গার, এলজি, লিন্যাক্স ইলেকট্রনিক্স, ইলেকট্রা ইন্টারন্যাশনাল, ইউনিটেক, ভিশন, র‌্যাংগস, এক্যুয়ার ইলেকট্রনিক্সসহ বেশকয়েকটি প্রতিষ্ঠান।
দন্ডবিধি আইন-১৮৬০ এর ২৯৪ (বি) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যবসা-বাণিজ্যের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি কিংবা কোনো পণ্য বিক্রির জন্য উপহার বা অন্য যে নামেই ডাকা হোক, কোনো কুপন টিকিট সংখ্যা বা ফিগারের মাধ্যমে প্রলোভন দেখিয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার দন্ডনীয় অপরাধ।
এ ধরণের অপরাধে সম্পৃক্ত ব্যক্তিকে এই ধারায় সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদন্ড বা জরিমানা বা উভর দন্ডে দন্ডীত করার বিধানও রয়েছে বলে জানান বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী এ্যাডভোকেট ফয়সল আহম্মদ রিয়াজ। আইন বিশেষজ্ঞরা জানান, ক্রেতা আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন উপহারের প্রলোভন দেখিয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার করা প্রচলিত আইনে নিষিদ্ধ। কেননা, ফ্রি অথবা বিদেশ ভ্রমণসহ অসংখ্য উপহার পাওয়ার আশাতেই সাধারণ অনেক ক্রেতা সংশ্লিষ্ট ব্র্যান্ডের পণ্যটি কিনতে আগ্রহী হয়ে উঠেন। কোনো উপহারের প্রলোভন না থাকলে তারা হয়ত পণ্যটি কিনতেন না। ফলে, কৌশলে পণ্য বিক্রয়ের একটি সহায়ক মাধ্যম হচ্ছে উপহারের প্রলোভন দেখানো। যা প্রকৃতঅর্থে সাধারণ ক্রেতার সাথে এক ধরণের প্রতারণা। তাই, দন্ডবিধি আইন-১৮৬০ এর ধারা ২৪৯ (বি) ধারায় এ ধরণের বিজ্ঞাপন প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
তারা আরো বলেন, অনেক ক্রেতাই এই বিষয়ে সচেতন নয়। আর এই সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন উপহারের প্রলোভন দেখিয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার করছে ইলেকট্রনিক্সসহ অন্যান্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান।
আইনবিরোধী অফারের বিজ্ঞাপন প্রচার বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে মিনিস্টার এর ব্র্যান্ড ম্যানেজার সোহেল কিবরিয়া বলেন, অফারের বিজ্ঞাপন শুধু মিনিস্টারই নয়; দেশের আরো অনেক প্রতিষ্ঠানই প্রচার করছে। তাদেরকেও জিজ্ঞাসা করুন। তাছাড়া, এ ধরণের বিজ্ঞাপন প্রচারের কারণে জনগণেরতো কোনো ক্ষতি হচ্ছেনা। কিন্তু তারা আইন লঙ্ঘন করছেন কিনা তা জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, এটা আমাদের কর্তৃপক্ষের বিষয়।


জানা গেছে, আসন্ন কোরবানী ঈদকে ঘিরে দেশজুড়ে এখন ফ্রিজ বিক্রির মৌসুম চলছে। মূলত, কোরবানির গোসত সংরক্ষণের জন্য ঈদের আগে প্রতিবছরই ফ্রিজের চাহিদা ও বিক্রি বেড়ে যায়। বরাবরের মতো এবারও কোরবানীর আগে ফ্রিজের চাহিদা বেড়েছে। আর ঈদে ফ্রিজের এই বাড়তি চাহিদার সুযোগে নিজেদের পণ্য বিক্রি বাড়াতে কতিপয় ইলেকট্রনিক্স ব্র্যান্ড বিভিন্ন অফার সম্বলিত বিজ্ঞাপন প্রচার করছে দেশের দৈনিক পত্রিকা, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, অন-লাইন নিউজ পোর্টালসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। অভিযোগ রয়েছে- এসব অফারের নামে প্রলোভন দেখিয়ে নি¤œমানের পণ্য ক্রেতাদের গছিয়ে দেয়া হচ্ছে।
কোম্পানিগুলো সাধারণ ক্রেতাদের ঈদ অফার বা বিশেষ উপহারের নামে স্ক্র্যাচ কার্ড ঘষলেই নিশ্চিত পুরস্কার, নগদ ছাড়, বিশেষ ছাড়, বিদেশ ভ্রমন, ফ্রিজ কিনলে কসাই ফ্রি, একটি কিনলে আরেকটি ফ্রিসহ বিভিন্ন ধরণের প্রলোভন দেখাচ্ছে। যা কিনা দন্ডবিধি আইনের ২৪৯ এর (বি) ধারা মোতাবেক আইনবিরোধী অপরাধ। এই আইনটি সম্পর্কে বেশিরভাগ ক্রেতারই ধারণা না থাকার সুযোগে আইন লঙ্ঘন করে এসব বিজ্ঞাপন প্রচার করছে ইলেকট্রনিক্স পণ্য বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। আর এ ধরণের ফাঁদে পা দিয়ে প্রতারিত হচ্ছেন সাধারন ক্রেতা।
সম্প্রতি একটি দৈনিক পত্রিকায় ইলেকট্রনিক্স পণ্য বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান সিঙ্গার ফ্রিজের একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। যেখানে লেখা রয়েছে- “ঈদ অফারে সবাই কাত ৩০০ ফ্রি ফ্রিজে বাজিমাত।” আগস্ট মাস জুড়ে সিঙ্গার থেকে ফ্রিজ কিনে ৬৯৬৯ নাম্বারে এসএমএস করে জিতে নিতে পারেন আপনার ফ্রি ফ্রিজটি। বিজ্ঞাপনে সারাদেশে প্রথম সপ্তাহে ৭০ জন ক্রেতা সিঙ্গার ফ্রিজ পাওয়ার কথাও জানানো হয়েছে।
শুধুমাত্র লটারির মাধ্যমে বিজয়ী ক্রেতাই সিঙ্গারের ফ্রি ফ্রিজটি পাবেন। আর ঈদ বাজারে সাধারণ ক্রেতাদের এভাবেই ফ্রি ফ্রিজের প্রলোভন দেখিয়ে নিজেদের ফ্রিজ বিক্রি বাড়ানোর চেষ্টা করছে সিঙ্গার, যা প্রচলিত আইনবিরোধী অপরাধ। ফ্রি ফ্রিজ পাওয়ার প্রলোভনে হয়ত অনেক ক্রেতা এই ব্র্যান্ডটির ফ্রিজ ক্রয়ে আগ্রহী হচ্ছেন। অথচ, সব ক্রেতাই কিন্তু ফ্রি ফ্রিজটি পাচ্ছেন না। তাই এ ধরণের বিজ্ঞাপনে প্রলুব্ধ হয়ে অনেক ক্রেতাই হচ্ছেন প্রতারিত।
পত্রিকায় প্রকাশিত লিনেক্স ইলেকট্রনিক্স এর টিভি ও ফ্রিজের বিজ্ঞাপনেও লেখা রয়েছে ‘হাউ কাউ অফার’। স্ক্র্যাচ করলেই নিশ্চিত উপহারের ঘোষণাও রয়েছে বিজ্ঞাপনে। যা কিনা শুধুমাত্র লিনেক্স ব্র্যান্ডের রেফ্রিজারেটর ও টিভি ক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বিজ্ঞাপনটিতে আরো লেখা রয়েছে ১ম পুরস্কার ঢাকা-ব্যাংকক-ঢাকা এয়ার টিকেট, ২য় পুরস্কার হিসেবে রেফ্রিজারেটর এবং ৩য় পুরস্কার হিসেবে ৪৩ ইঞ্চি এলইডি টিভি। এ ছাড়া সকল পণ্যে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ ছাড় লেখা রয়েছে। অফারটি ১লা আগস্ট থেকে ঈদের দিন পর্যন্ত দেশজুড়ে লিনেক্স এর ১০০ শোরুমে মিলবে বলেও জানানো হয়েছে বিজ্ঞাপনটিতে।
বিজ্ঞাপনে পুরস্কার হিসেবে ঢাকা-ব্যাংকক-ঢাকা এয়ার টিকেট, রেফ্রিজারেটর ও এলইডি টিভির প্রলোভন দেখালেও সকল ক্রেতা এসব উপহার প্রাপ্তির কোনো নিশ্চয়তা নেই। আবার সকল ক্রেতাই যে সমান ছাড় পাবেন সেটারও নিশ্চয়তা নেই। মূলত, সুকৌশলে হাউ কাউ অফারের নামে ক্রেতাদের বিভিন্ন উপহারের প্রলোভন দেখিয়ে কোম্পানিটি ফ্রিজ ও টিভির বিক্রি বাড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে।
এদিকে ইউনিটেক একটু ব্যতিক্রমী অফার দিয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার করছে। পত্রিকায় প্রকাশিত ইউনিটেক এর ফ্রিজ, এসি ও টিভির বিজ্ঞাপনে ‘ফ্রিজ কিনলেই কসাই হাজির’ অফারের কথা লেখা রয়েছে। অফারটির ঠিক নিচেই লেখা রয়েছে- “এই ঈদে ইউনিটেকের ফ্রিজ কিনে স্ক্র্যাচ কার্ড ঘষে আপনিও পেতে পারেন ফ্রি কসাই। এছাড়া প্রত্যেক ফ্রিজে থাকছে আকর্ষণীয় পুরস্কার।” অফারটি ১ আগস্ট থেকে ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলবে বলেও জানানো হয়।
আইন লঙ্ঘন করে এ ধরণের বিজ্ঞাপন প্রচার করার বিষয়ে কথা বলতে বিজ্ঞাপনে দেয়া হটলাইন নাম্বারে ফোন করলে মারিয়া নামে ইউনিটেকের একজন কর্মী বলেন, তিনি এ বিষয় সম্পর্কে অবগত নন। সংশ্লিষ কর্মকর্তাও এই মুহুর্তে অফিসে নেই বলে তিনি জানান।
ইলেকট্রা ইন্টারন্যাশনাল এর বিজ্ঞাপনে দেখা যায়- একটি উড়োজাহাজ, টেলিভিশন ও মোটারসাইকেল ছবি দিয়ে পাশে ‘জিতে নিন’ শিরোনামে নিচে লেখা রয়েছে মোটরসাইকেল, ৫০ ইঞ্চি এলইডি টিভি, বিদেশ ভ্রমন প্যাকেজ। এছাড়াও, বিজ্ঞাপনটিতে প্রতিটি পণ্য ক্রয়ে ‘ক্যাশ ব্যাক’ এবং এর নিচেই ৫’শ ও ১ হাজার টাকা নোটের তিনটি বান্ডেল এর ছবি রয়েছে। এই সুযোগ ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ইং পর্যন্ত চলবে বলেও জানানো হয়েছে বিজ্ঞাপনে।
আবার, রাজধানীর ইলেকট্রনিক্স পণ্য কেনা-বেচার সর্ববৃহৎ বাজার স্টেডিয়াম মার্কেটসহ বিভিন্ন এলাকার ইলেকট্রনিক্স শোরুমগুলো ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশতেই ঝোলানো রয়েছে ব্যতিক্রমী ধরনের ঈদ অফারের বড় বড় পোষ্টার ও ব্যানার। যেগুলোতে লেখা রয়েছে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত নগদ মূল্য ছাড়া, ৫০ শতাংশ বান্ডেল মূল্য ছাড়, ফ্রি গিফট, রাফেল ড্র, স্ক্র্যাচ কার্ড ঘষলে নিশ্চিত পুরস্কার, ক্যাশব্যাক, একটি কিনলে একটি ফ্রি ফ্রিজ ও টিভিসহ অসংখ্য অফার। আর এসব অফারে আকৃষ্ট হয়ে শোরুমে ঢুকতেই ক্রেতাদের গছিয়ে দেয়া হচ্ছে ফ্রিজ, টিভিসহ বিভিন্ন পণ্য। কিছু বিক্রেতা আবার নিশ্চিত আকর্ষণীয় পুরস্কারের মিথ্যা আশ্বাসও দিচ্ছেন ক্রেতাদের। কেউ কেউ পণ্যের গায়ে আগের চেয়ে বেশি দামের মূল্য তালিকা লাগিয়ে তার উপর নগদ ছাড়ের অফার দিয়ে ক্রেতাদের বিভ্রান্ত করছে।
ফ্রিজ ও টিভিতে কোরবানী উপলক্ষ্যে বিশেষ ঈদ উপহার দিচ্ছে এমন একটি শোরুমের বিক্রয়কর্মীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, পণ্য কিনে স্ক্র্যাচ কার্ড ঘষলেই পুরো টাকা ক্যাশব্যাকের সম্ভাবনার রয়েছে এমন অফার দেয়া থাকলেও, এখন পর্যন্ত কোনো ক্রেতাই বড় কোনো পুরস্কার জিতেনি। এখন পর্যন্ত অধিকাংশ ক্রেতাই স্ক্র্যাচ কার্ড ঘষে পেয়েছেন সর্বোচ্চ ১ হাজার টাকার ক্যাশ ব্যাক। তবে ঈদ অফারের ফলে ফ্রিজ ও টিভি বিক্রি কয়েকগুণ বেড়েছে বলে জানান বিক্রয়কর্মী।
স্টেডিয়াম মার্কেটের একটি শোরুমে আসা ক্রেতা বেসকরকারি ব্যাংকের কর্মী সানজিদা আক্তার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, পণ্য কিনলে বিশাল অঙ্কের ক্যাশব্যাকসহ মিলবে বিভিন্ন নিশ্চিত আকর্ষণীয় পুরস্কার-বিক্রয়কর্মীর কাছ থেকে এ ধরণের আশ্বাস পেয়ে মাঝারি সাইজের একটি ফ্রিজ ও ৩২ ইঞ্চি এলইডি টিভি কিনলাম। কিন্তু, স্ক্র্যাচ কার্ড ঘষে দুটি পণ্যে সর্বসাকুল্যে ২ হাজার টাকা ক্যাশব্যাক পেলাম। এতেও খুশি ছিলাম। কিন্তু, এখান থেকে বের হতেই পাশের দোকানে একই পণ্যের গায়ে আরো কম দাম লেখা দেখলাম। নেই কোনো অফার। তখনই বুঝলাম- অফারের ফাঁদে পড়ে বেশি দামে পণ্য কিনে ঠকেছি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top