সকল মেনু

দেশবাসীর কাছে শিল্পী জব্বার ১ টাকা করে চেয়েছেন

বঙ্গবন্ধু গ্রীক-উপাখ্যানের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভঙ্গকারী বিদ্রোহী প্রমিথিউসের ন্যায় কুম্ভকন্ঠ উচ্চারণে বলতে পারতেন,
“হোয়াট এভার দি পেরিল, দি ডোম, দি পেইন সেলফ্ এক্সিসট্যান্ট আই স্টিল রিমেইন – জিউস’স হ্যান্ড ক্যান নেভার ডেস্ট্রয় মি।”
(অর্থাৎ আগ্রাসী থাবা বিস্তার করুক পৃথিবীর যতো দুর্যোগ এবং ধ্বংস তান্ডব, কিন্তু আমি আছি থাকবো আপন অস্তিত্বে অক্ষয়। পারবেনা কখনও ধ্বংস করতে আমাকে জিউসের হাত।) একাত্তরের রণাঙ্গনে এটি শেকল- ছেঁড়ার গান নয়, তবুও বিদ্রোহী বীর প্রমিথিসের চিত্তজয়ী বিশ্ববিখ্যাত উক্তিটি উচ্চারণ করলেন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে শয্যাশায়ী দেশবরেণ্য শিল্পী আব্দুল জব্বারের কন্ঠে।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যার উদাত্ত জলদগম্ভীর কন্ঠ সাড়ে সাতকোটি প্রাণে গেঁথে দিয়েছিল মুক্তির গান সেই মহান শিল্পী এখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে শয্যাশায়ী। কেবিন থেকে ‘নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে’ নিয়ে যাওয়ার কয়েক ঘন্টা আগে তার মুখোমুখি হলে শোকের মাসের কথা স্মরিয়া বললেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু যেদিন সপরিবারে নিহত হয়েছেন সেদিন থেকেই মরে বেঁচে আছি। তাঁকে আমি বাবা বলে ডাকতাম। পুত্রস্থানীয় স্নেহরস তাঁর অমোঘ বজ্রকন্ঠে লেপটে থাকতো। আমি তাঁর রক্তের উত্তরাধিকার দাবি করতে না পারলেও প্রাণের বা আত্মার উত্তরাধিকার দাবি করছি। তাই শোকের মাসে তাঁকে স্মরণ না করে আমার বেঁচে থাকার আকুতিটা নিস্পন্দিত থেকে যায় বলেই প্রমিথিউসের গ্রীক উপাখ্যানের ভাষায় বঙ্গবন্ধুর প্রতি শয্যাতলে থেকে বিনম্র শ্রদ্ধা ও শোক প্রকাশ করছি।

সঙ্গীতে কিংবদন্তিতুল্য আব্দুল জব্বার নিজেকে একটি উদ্বেলিত শোকসমুদ্রে পরিণত করে যেন তার অন্তিম মুহূর্তকে পার করে চলছিলেন। কন্ঠে চিন্তায় আদর্শে পুরোদস্তুর এক স্বদেশী শিল্পীর সঙ্গে মুক্তির সংগ্রামে সেকি আশ্চর্য যোগসূত্র! কিডনিসহ নানা শারীরিক সঙ্কটে সঙ্কটাপন্ন আব্দুল জব্বারের প্রতিটি গান অসাধারণ ও অতুলনীয় হলেও শয্যায় বসে একটি গানের কথাই এগিয়ে রাখলেন -“তুমি কি দেখেছো কভু জীবনের পরাজয়, দুখের দহনে করূণ ক্রন্দনে তিলে তিলে তার ক্ষয়।” মৃর্তুযুদ্ধে অবতীর্ণ অবিসংবাদী সঙ্গীত শিল্পীর চোখে ততক্ষণে বয়ে চললো কান্নার সাঁতার। হাসির ফোয়ারা উবে গেছে তার আকাশের নীল হারিয়ে। মনস্তাত্ত্বিক রাজত্বে আর মানসভূমিতে কম্পমান স্বরগতি থামলো ‘ওরে নীল দরিয়ায়।’

আব্দুল জব্বারের কন্ঠধ্বনি সঙ্গীতের মূর্ছিত অধ্যায়ে এক ব্যতিক্রমী ব্যক্তিসত্তারই ক্রমবিকাশ। যা আবহমান বাংলার সঙ্গীতের ভুবনকে সমৃদ্ধ করেছে অনায়াসে অনুপমেয় করেছে সঙ্গীতের আঙ্গিক পরিসরকে। প্রচন্ড যন্ত্রণাকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গে পরিণত করে দাবানল সৃষ্টি করতে সমর্থ হওয়া এ প্রবীণ শিল্পী পঞ্জীভূত হতাশার চাদর পেচিয়ে এক উদ্ধিপ্ত প্রত্যাশাকে লালন করে এখনও বেঁচে থাকার ধ্রুব বিশ্বাসে, অমিত সাহস বুকে ধরাণ করে চলছিলেন। বেঁচে থাকার অদমনীয়তায় তিনি বললেন, “আব্দুল জব্বার যদি জাতি গঠনের সংগ্রামে গান গেয়ে গেয়ে কোন ভুমিকা রেখেই থাকেন তবে, ষোল কোটি মানুষ এক টাকা করে আমাকে দিক, আমার সুচিকিৎসা হবে। আমার দেহে স্থাপিত হবে দুটি কিডনী, নিশ্চয়ই বেঁচে যাবো আমি।

 

দেশবরেণ্য সহকর্মী শিল্পীদের কাছ থেকে কোন সাহায্য সহায়তা পাচ্ছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে আব্দুল জব্বার বললেন, এটা আমি আশা করি না, কেননা ঐতিহাসিক ভাবেই শিল্পীরা গরীব। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দেয়া বিশ লক্ষ টাকার সব ফুরিয়েছে চিকিৎসা ব্যয়ে জানিয়ে বললেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছেই আমার দাবি তিনিই পারেন আমার চিকিৎসা নিশ্চিত করতে। কারণ তিনি শুধু প্রধানমন্ত্রী নন, জাতির পিতার কন্যা হিসাবে তাঁর কাছে আমার প্রত্যাশা অনেক বড়। মহান আল্লাহ তাকে বার মৃত্যুর দূয়ার থেকে মুক্ত করেছেন। তার কৃপায় আল্লাহর রহমতে আমিও সুস্থ হয়ে উঠবো এমন বিশ্বাসের বানী শুনালেন আব্দুল জব্বার।
উজানের বিপদ সঙ্কুল পথে যাত্রা শুরু করে সঙ্গীতের এক নতুন তরঙ্গ সৃষ্টি করে বাংলা গানের সব শাখায় নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে সঙ্গীত শিল্পী জব্বার। সেই তিনি নিস্তরঙ্গ সমুদ্রে প্রচন্ড ঝড়ের কবলে পড়েও মৃত্যুর বিরুদ্ধে যেন জলদগম্ভীর কন্ঠ ছাপিয়ে আমার কন্ঠ গেয়ে চললো- “প্রেমের সমাধি ফুলেফুলে ঢাকা, কে বলে নেই, তুমি আছো মন বলে তাই।”

লেখক, কলামিস্ট : সোহেল সানি

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top