সকল মেনু

লোকালয়ে গোখরা কেন

হটনিউজ ডেস্ক: রাজশাহীর তিন এলাকায় গত এক সপ্তাহে বসতবাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে ১৮৩টি গোখরা সাপ। দেশের আরও কয়েকটি জেলাতেও পাওয়া গেছে এমন খবর। আর তাতে প্রশ্ন জেগেছে লোকালয়ে হঠাৎ কেন গোখরা সাপ? ওয়াইল্ড লাইফ নিয়ে যারা কাজ করেন তারা বলছেন, এটি স্বাভাবিক ঘটনা। ডাঙার গোখরা বর্ষাকালে শুকনো উঁচু জায়গা ও বসতবাড়িতে জায়গা খুঁজে নেয়। তবে সাপগুলোকে মেরে না ফেলে বনবিভাগের কাছে দিয়ে দেওয়া উচিত ছিল বলেও মন্তব্য তাদের। তারা বলছেন, যেহেতু সাপ নিজে গর্ত খুঁড়তে পারে না তাই এসময় উঁচু জায়গা বা বসতবাড়ির ভেতরে থাকা ইঁদুরের গর্তে জায়গা করে নেয় ডাঙার গোখরা আর খাদ্য হিসেবে ইঁদুরও তাদের পছন্দের।

গত এক সপ্তাহে রাজশাহী অঞ্চলে প্রায় দুইশ’ গোখরা সাপ মারার ঘটনাই কেবল ঘটেছে তা নয়, একইসঙ্গে সাপগুলোর পাড়া ডিমও নষ্ট করা হয়েছে। এত প্রাণ বিপর্যয়ের দরকার ছিল না উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ফিরোজ জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, গোখরা দুই প্রকারের হয়: ডাঙার গোখরা ও পানির গোখরা। যেসব সাপ দেখা গেছে সেগুলো ডাঙার গোখরা। সবসময়ই এসব সাপ উঁচু ডাঙা ও শুকনা জায়গার বসত ভিটায় থাকে। তবে বর্ষায় বেশি নজরে পড়ে। কারণ, পানি থেকে দূরে যেতে তারা তাদের বসত পরিবর্তন করে। ঘরের উঁচু জায়গায় মাটি পেলে তারা আশ্রয় নেয়। তিনি আরও বলেন, সাপ নিজে গর্ত করতে পারে না। অন্য প্রাণীর গর্ত বিশেষত ইঁদুরের গর্তে থাকতে পছন্দ করে। কারণ, ইঁদুর সাপের খাদ্য। রাজশাহী এলাকার সাপগুলোর বিষয়ে তিনি বলেন, রাজশাহীতে সাপ তুলনামূলক বেশি। এমনিতেই সাপের প্রজনন ক্ষমতাও বেশি। একটি সাপ যদি পৌনে ২শ’ ডিম পাড়ে এবং তার মধ্যে ৭০ শতাংশ ডিম ফোটাতে সক্ষম হয় তাহলে কতগুলো সাপ হওয়ার কথা! খেয়াল করে দেখবেন, মেরে ফেলা সবগুলো সাপ ছোট, এক দেড় হাতের।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এম খালেকুজ্জামান মনে করেন, ঝোপঝাড় কমে যাওয়ার কারণে এবং গরমে সাপ গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে বলে দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। তিনি বলেন, ঝোপঝাড় কমায় বসতবাড়ির ইঁদুরের গর্তে গিয়ে সাপ ডিম পাড়ছে। শীতকালে সাপ গর্তে থাকে। আর বর্ষা ও গরমে সাপ গর্ত থেকে বের হয়। এই কারণে, সাপ এখন দেখা যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, এখন সাপের প্রজননকাল। মিলনের পর পুরুষ সাপটা অন্য জায়গায় চলে যায়। আর মা সাপটা গর্তে গিয়ে ডিম পাড়ে। ডিম দেওয়া শেষ হলে সেও অন্য কোথাও চলে যায়। ৬০ দিন পর সাপের ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। এর এক সপ্তাহ পর বাচ্চা সাপগুলোর খোলস বদল হয় এবং চোখ ফোটে। এরপরই প্রায় সব সাপ একসঙ্গে গর্ত থেকে বের হতে শুরু করে। তিনি আরও বলেন, আর কারও বাড়িতে সাপ নেই, তা নয়। থাকতেই পারে। তবে সাপ নিজে আক্রান্ত না হলে কাউকে কামড় দেয় না। সাপের আতঙ্ক থাকলে বাড়িতে কার্বলিক অ্যাসিড রাখা যেতে পারে।

অনেক দিন ধরেই নিজের বাড়িতে সাপ সংরক্ষণ ও পালন করছেন রাজশাহীর পবা উপজেলার যুবক বোরহান বিশ্বাস রোমন। রাজশাহীতে সাপগুলোকে মেরে ফেলার ব্যাপারে বোরহান বিশ্বাস রোমন বলেন, আমি মাজদারের বাড়িতে ২৭টি সাপ মেরে ফেলার পরদিন ওই বাড়িতে গিয়েছিলাম। খুঁজেছিলাম আর কোনও জীবিত সাপ আছে কিনা। কিন্তু, কোনও সাপ পাইনি।

তিনি বলেন, প্রত্যেক প্রাণির বাঁচার অধিকার আছে। এতোগুলো সাপের একসঙ্গে মৃত্যু দেখে খুব খারাপ লাগছে। সাপগুলো দেখার পর আমরা যারা সাপ নিয়ে কাজ করি তাদেরকে খবর দেওয়া যেত। আমরা সাপগুলোর জীবন বাঁচাতে পারতাম। বাড়ির লোকজনকেও নিরাপদে রাখতাম। যেভাবে সাপ মারা হয়েছে সেটাও একটা ঝুঁকি।

তবে প্রতিবছর বর্ষাকালে বরেন্দ্র অঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় এমন ঘটনার খবর পাওয়া গেলেও বনবিভাগের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে সচেতনতামূলক কোনও উদ্যোগ চোখে পড়ে না।

এ বিষয়ে রাজশাহীর সহকারী বন সংরক্ষক একেএম রুহুল আমিন বলেন, গত তিন বছরে রাজশাহীসহ পুরো বরেন্দ্র অঞ্চলে গোখরা সাপ অধিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব বন্যপ্রাণি সংরক্ষণে অচিরেই তারা জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম হাতে নেবেন। এতে জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের আরেক অধ্যাপক নিয়ামুল নাসের  বলেন, এই ডাঙা গোখরা অন্য কোথাও থেকে মাইগ্রেটেড হয়ে এসেছে এমন নয়। যেখানে ধরা পড়েছে সেখানেই ছিল। তবে এগুলো মেরে না ফেলে সংরক্ষণ করা জরুরি ছিল। স্থানীয় বন বিভাগ যদি এগুলো সংগ্রহ করে নিতে পারতো তাহলে ভালো হতো। তবে মনে রাখা দরকার, এগুলো বাচ্চা সাপ হলেও বিষাক্ত এবং এ বিষয়ে সতর্কতাও জরুরি।

তবে প্রাণি হিসেবে সাপ সংরক্ষণের জন্য সংশ্লিষ্টদের তাগিদ যেমন, তেমনই বাসাবাড়িতে কেউ-ই চান না এই প্রাণিটির উপদ্রবও। কারণ, যুগ যুগ ধরেই সাপকে বিষধর ও ভীতিকর প্রাণি হিসেবেই চেনে সাধারণ মানুষ। আর গোখরার মতো বিষধর সাপ দেখলে যে কেউ ভয় পেতে বাধ্য। তারপরেও বরেন্দ্র এলাকার মাটির ঘরগুলোতেই সাপের আস্তানার খবর পাওয়া যায় বেশি। রাজশাহী গোদাগাড়ী উপজেলার মহিশালবাড়ী এলাকার রেজাউল করিম নামের এক ব্যক্তি  জানিয়েছেন তার বাড়িতে সাপ পাওয়ার অভিজ্ঞতা। তিনি বলেন, আমাদের বাড়িটি ছিল মাটির তৈরি। কিন্তু তিন বছর আগে একদিন গোখরা সাপ দেখি। এক গর্ত থেকে ১০টি সাপ বের করে মেরে ফেলি। এরপর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। ধার করে হলেও আর মাটির বাড়ি রাখবো না। তাই মাটির বাড়ি ভেঙ্গে ইট দিয়ে তৈরি করেছি। এখন তেমন ভয় লাগে না।

সাভার বেদে পল্লীর সাধারণ সম্পাদক মো. রমজান  জানান, বর্ষা মৌসুমে গোখরাসহ অনেক প্রজাতির সাপ ডিম পাড়ে। এগুলো সাধারণত বনজঙ্গল বা উঁচু ঢিবির মধ্যে থাকে। কিন্তু, বর্ষাকালে পানি ওঠার কারণে সাপের উঁচু জায়গা বা বাড়িঘরে আশ্রয় নেয়। সেখানেই ইঁদুরের গর্তে থাকে। ডিম পাড়ে ও বাচ্চা দেয়।

মানিকগঞ্জে কৃষকের বাড়িতে গোখরা (১১ জুলাই)নি আরও বলেন, বাসা-বাড়িতে থাকা সাপ কাউকে কামড়ায় না, এটাও ঠিক কথা নয়। মনে রাখতে হবে, সাপ ভয় পেলে বা আক্রান্ত হলেই ছোবল মারে। তবে গোখরা হচ্ছে খুবই বিষাক্ত সাপ। এগুলো কোনও ঘরে দেখা দিলে নিজেরাই না মারার চেষ্টা করে স্থানীয় সাপুড়েদের খবর দেওয়া ভালো, তাহলে তারা সহায়তা করবেন। ঘরে সাপ দেখলে তাকে উত্ত্যক্ত না করে ঘর থেকে বের হয়ে অন্যদের ডেকে এটিকে ধরতে হবে।

উল্লেখ্য, গেল বুধবার রাজশাহী মহানগরীর বুধপাড়া এলাকার বাসিন্দা মাজদার আলীর শোবার ঘরে পাওয়া যায় ২৭টি বিষধর গোখরা সাপ। এর পরদিন ওই ঘরেই পাওয়া যায় আরও একটি সাপ। এক থেকে দেড় হাত মতো লম্বা প্রতিটি সাপের বাচ্চাকেই পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। এর একদিন পরই বৃহস্পতিবার রাজশাহীর তানোর উপজেলার ভদ্রখণ্ড গ্রামের কৃষক আক্কাস আলীর বাড়ির রান্নাঘরের মাটি খুঁড়ে পাওয়া যায় ১২৫টি বিষধর গোখরার বাচ্চা। ছোট ছোট এসব সাপের বাচ্চাগুলোকেও পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। এই বাড়িতে গোখরার ১৩টি ডিমও পাওয়া যায়। বাড়ির মালিকরা জানান, নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থেই মেরে ফেলা হয় সাপগুলোকে। এরপর থেকে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন গ্রামের মানুষ। সোমবার (১০ জুলাই) রাজশাহী দুর্গাপুর উপজেলায় হোজা গ্রামে রবিউলের বাড়ির ভেতরে প্রায় ৩০টি গোখরা সাপ মেরে ফেলা হয়েছে। সঙ্গে ৪৫টি সাপের ডিম নষ্ট করা হয়েছে।

এছাড়াও শনিবার (৮ জুলাই) সাতক্ষীরার সদর উপজেলার ধুলিহর ইউনিয়নের বালুইগাছা গ্রামের সাত্তার খানদারের বাড়িতে একই গর্ত থেকে ৫৬টি সাপ বের করে মেরে ফেলা হয়। সেখানে সাপের ৫০টি ডিমও নষ্ট করা হয়। অন্যদিকে, আশাশুনি উপজেলার বুধহাটা ইউনিয়নে বেউলা গ্রামের মকবুল সরদার ওরফে খোকনের বসতঘরের একটি গর্ত থেকে ২০টি গোখরা সাপ বের করে মেরে ফেলা হয়।

অন্যদিকে, সোমবার (১০ জুলাই) কুষ্টিয়ার মিরপুরে নাজমুল ইসলাম লিটন নামে এক ব্যক্তির বসতবাড়ির রান্নাঘরে ২৮টি গোখরা সাপ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ২৭টি বাচ্চা। বাচ্চাগুলোকে মেরে ফেলেছেন স্থানীয়রা। আর মা সাপটিকে ধরে আটকে রেখেছেন এক সাপুড়ে। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে উপজেলার সদরপুর ইউনিয়নের সদরপুর স্কুল পাড়ার লিটনের রান্নাঘরে এ সাপগুলো পাওয়া যায়।

একইদিনে রাজবাড়ী জেলা সদর উপজেলার মুলঘর ইউনিয়নের বাঘিয়া গ্রামের মুদি দোকানি আবু জাফরের বসতঘর থেকে ৬টি বিষধর গোখরা সাপ বের করে মেরে ফেলা হয় ও সাপের ২৪টি ডিমের খোসা দেখতে পাওয়া যায়।

এছাড়া আজ মঙ্গলবার (১১ জুলাই) মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার ধানকোড়া ইউনিয়নের কৃষক আফাজ উদ্দিনের বাড়িতে ১৯টি গোখরা সাপের বাচ্চা মেরে ফেলা হয়েছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top