সকল মেনু

হাসিনার সফরে পানি চুক্তির জন্য মোদির যত তৎপরতা

কলকাতা প্রতিনিধি: ধারণার বাইরে গিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফর শেষ হয়েছে, একটি উৎসাহব্যঞ্জনার মধ্য দিয়ে। ভারতের পক্ষ থেকে এরইমধ্যে তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে ঢাকার উদ্বেগের ব্যাপারে দুই স্তরভিত্তিক সাড়া আসতে শুরু হয়েছে।

প্রথমত প্রশাসনিক স্তরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সামগ্রিক পরিস্থিতি পরিদর্শনে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিশেষজ্ঞ কমিটি পাঠাচ্ছেন। এ কমিটি আটটি জলবিদ্যুৎ বাঁধ এবং সিকিম জলাধারের কাজ পর্যালোচনা করবে। এই কমিটি পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রকল্পে পানি সংরক্ষণ নিয়ে গবেষণা এবং তিস্তার পানি ইস্যুতে পশ্চিমবঙ্গের কাছ থেকে চূড়ান্ত ছাড়পত্র আদায় নিয়ে কাজ করবে। তারা পরিবেশের ওপর এসব প্রকল্পের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করবেন। এছাড়া সিকিমভিত্তিক কর্মকর্তাদের সঙ্গেও নদীর প্রবাহ নিয়ে কথা বলবেন তারা।

আগামী মে মাসে পশ্চিমবঙ্গের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হবে এ কমিটি। পানিবণ্টন প্রকল্পের ব্যাপারে একটা চূড়ান্ত ও নিষ্পত্তিমূলক উপসংহারে আসতেই এ বৈঠক।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় দিল্লিতে বাংলাদেশ ও ভারতের দুই প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন, শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার পানির প্রায় ৬০ শতাংশই ব্যবহৃত হয় সিকিমের প্রজেক্টগুলোতে। বাকি মাত্র ৪০ শতাংশ পানিপ্রবাহ উত্তরবঙ্গ পর্যন্ত পৌঁছায়। এর ফলে উত্তরাঞ্চলীয় ছয় জেলায় কৃষিকাজের জন্য প্রয়োজনীয় পানির যোগান দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এখন যদি এই স্বল্প পরিমাণ পানি বাংলাদেশের সঙ্গে ভাগাভাগি করা হয়; তাহলে উত্তরবঙ্গের ওই ছয় জেলার জন্য আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের কর্মকর্তাদের দাবি, শেখ হাসিনার ভারত সফরের দুদিন আগেই বিদ্যমান পরিস্থিতি সম্পর্কে একটা বিশদ প্রতিবেদন কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে। বিভ্রান্তি এড়াতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় চাইছেন, উভয় প্রধানমন্ত্রী যেন বিদ্যমান পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত হন। এখানে বাংলাদেশের মানুষের পানির ন্যায্য হিস্যা অস্বীকারের কোনও অভিপ্রায় নেই। বাংলাদেশের প্রয়োজন মেটাতে তিনি তোর্সা’সহ অন্যান্য নদীর পানি ব্যবহার সংক্রান্ত একটি বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছেন।

এমনকি এর আগে পানিবণ্টন নিয়ে সিকিমের ব্যাপারেও কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে অনুযোগ তুলেছিলেন তিনি। সে সময় তিনি কেন্দ্রীয় সরকারকে এ ব্যাপারে সিকিমের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনার আহ্বান জানান।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এমন অবস্থানের ফলে পশ্চিমবঙ্গের উদ্বেগের বিষয়টিতে কেন্দ্রীয় সরকারও মনোযোগী হয়। মমতার ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো বলছে, এটা সম্ভব হলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হাসিনার বিমূঢ়তা কিছুটা এড়ানো যেতো।

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের তরফে এখনও পর্যন্ত তিস্তার পানি সংক্রান্ত কল্যাণ রুদ্র কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি। এটি প্রকাশ না করার পেছনে কোনও দাফতরিক ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়নি। অথচ মমতার পরামর্শ ও নির্দেশনা অনুযায়ী ওই কমিটি তাদের কার্যক্রম সম্পন্ন করেছিল।

এখন পানিবণ্টন ইস্যু নিয়ে কাজ করবে কেন্দ্রীয় সরকারের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি। তারা একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে তাদের কাজ করে যাবে। তারা শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির দিকগুলোই দেখবে না; বরং তিস্তায় পানির প্রাপ্যতা সংক্রান্ত বিভ্রান্তিও দূর করবে।

দ্বিতীয়ত, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকলেও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারে এখন ক্ষমতায় ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। মমতার তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে এখন পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক প্রচারণা চালাচ্ছে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি’র নেতারা। প্রস্তাবিত তিস্তা নদীর পানিবণ্টন ইস্যু নিয়ে জনগণের চিন্তাভাবনার বিষয়টিও অনুধাবন করতে চাইছে দলটি।

চলতি বছরের মার্চে জনসংখ্যার দিক থেকে ভারতের বৃহত্তম রাজ্য উত্তর প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে মোদি ঝড়ে তছনছ হয়ে গেছে বিরোধীরা। নির্বাচনে ভরাডুবি হয়েছে সমাজবাদী পার্টি, কংগ্রেস এবং বহুজন সমাজপার্টির। উত্তর প্রদেশের ফল প্রকাশের পর পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি শিবিরও এখন উদ্দীপ্ত। কারণ উত্তরের ঝড় শঙ্কা তৈরি করেছে পশ্চিমবঙ্গের বিজেপিবিরোধী রাজনীতিতে। এরইমধ্যে পশ্চিমবঙ্গকে টার্গেট করে নিজেদের বড় পরিকল্পনার কথাও ঘোষণা করেছে বিজেপি। মাঠ পর্যায় থেকেই তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে লড়াইয়ের পরিকল্পনা করছে দলটি। আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় এটি আরও পরিষ্কার হবে। এ নির্বাচনে যত বেশি সম্ভব বুথ কমিটি করার চেষ্টা করবে মোদি’র দল। বিজেপি’র সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন সংগঠনের কর্মী-সমর্থক ও সংগঠকরা এখন বিভিন্ন স্থানে গণবিক্ষোভের আয়োজন করছেন। তৃণমূল কংগ্রেসকে নিশানা বানিয়ে সুনির্দিষ্ট ইস্যুতে এসব বিক্ষোভের আয়োজন করা হচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব জমায়েত-বিক্ষোভে অংশ নিচ্ছেন বিপুল সংখ্যক মানুষ। ফলে বিষয়টি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মমতার তৃণমূল কংগ্রেসের জন্য সবচেয়ে বাজে বিষয় হচ্ছে, বিভিন্ন জেলায় কংগ্রেস এবং বাম দলগুলোর হতোদ্যম সমর্থকরাও বিজেপি’র এসব সভা-সমাবেশে অংশ নিচ্ছে। স্বভাবতই এটি রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ ছড়িয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে পুলিশ এবং প্রতিপক্ষ তৃণমূল কংগ্রেসের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আক্রমণাত্মক বিজেপি সমর্থকদের সঙ্গে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে।

পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি’র আইন বিষয়ক সেল-এর দায়িত্বে আছেন শান্তনু সিনহা। তিনি বলেন, ২০১১ সালে প্রথমবারের মতো পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসে মমতার দল তৃণমূল কংগ্রেস। এরপর থেকে এ ধরনের রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে ইতোপূর্বে কখনও তার সরকারকে পড়তে হয়নি। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে বিজেপি’র শীর্ষস্থানীয় ৪০ জনেরও বেশি নেতা পশ্চিমবঙ্গ সফরের কথা রয়েছে। এদের মধ্যে আমাদের বিজেপি’র কেন্দ্রীয় সভাপতি অমিত শাহ, কৈলাস ভিজাইবার্গিয়া’র মতো জাঁদরেল নেতারা রয়েছেন। এটা তৃণমূল কংগ্রেসের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করবে।

বিজেপি’র পক্ষ থেকে এখন এমন প্রচারণা চালানো হচ্ছে যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে অন্তর্ঘাতমূলক অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তাদের দাবি, মমতার এমন পদক্ষেপের ফলে আদতে এ অঞ্চলে পাকিস্তানই লাভবান হবে। এছাড়া উপকৃত হবে বাংলাদেশের ইসলামি মৌলবাদীরা।

বীরভূমে বিজেপি’র এক বিক্ষোভে লাঠিচার্জের প্রসঙ্গ তুলে এর সমালোচনা করেন রাজ্য বিজেপি’র সভাপতি দিলীপ ঘোষ। তিনি বলেন, আমরা যেন পশ্চিমবঙ্গে তালেবানি নিয়মের অধীনে রয়েছি। তবে মানুষ তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে এর উপযুক্ত জবাব দেবে।

কলকাতাভিত্তিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কোনও সুযোগই ছাড়তে চাইছেন না। পানিবণ্টন নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরোধিতাকে নিবৃত্ত করতে তিনি দুই ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। একদিকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রশাসনিক পদক্ষেপকে কাজে লাগানো হচ্ছে। অন্যদিকে রাজনৈতিকভাবে মাঠ পর্যায়ে সাধারণ মানুষকে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে।

বিজেপি নেতৃত্ব যদি মনে করে, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের অবস্থান ব্যাপক সমালোচনামূলক তাহলে পানিবণ্টন ইস্যুতে মমতাকে একটা চূড়ান্ত সুযোগ দেবে কেন্দ্রীয় সরকার। এটা হবে দিল্লি-কলকাতা সর্বোচ্চ বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের বৈঠকের শেষ ধাপে। তাতেও যদি সাফল্য না মেলে এবং  মানুষ যদি তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে পরস্পরবিরোধী অবস্থান পোষণ করেন তাহলে কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে একটা উপসংহারে আসতে পারে। সেটা পশ্চিমবঙ্গকে নিয়ে অথবা পশ্চিমবঙ্গকে ছাড়াও হতে পারে।

এদিকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও কিছুটা চাপের মুখে রয়েছেন। মধ্যমেয়াদে তিস্তা নদীর পানি বণ্টনের বিষয়ে ভালো খবর পাওয়ার আশা তিনি করতেই পারেন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top