সকল মেনু

শেখ হাসিনার প্রতি দিল্লির দৃষ্টিভঙ্গি বদলের নেপথ্যে!

হটনিউজ ডেস্ক: সময়ের ব্যবধানটা সাত বছরেরও বেশি। দিন-তারিখ গুণে বললে প্রায় সাত বছর তিন মাস – আর এই দীর্ঘ সোয়া সাত বছরের ব্যবধানে কোনও রাষ্ট্রীয় সফরে ভারতের রাজধানীতে আবার পা রাখতে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ভারতের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী দেশের সরকারপ্রধানের সফরের নিরিখে ব্যবধানটা একটু বেশি সন্দেহ নেই, কিন্তু এটাও অস্বীকার করা যাবে না এই সাত বছরের মধ্যে ভারতের বাংলাদেশকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গীও বদলে গেছে আমূল। তার অন্যতম কারণ যদি হয় বাংলাদেশ-ভারত সহযোগিতার নতুন নতুন ক্ষেত্রের সম্প্রসারণ, তেমনি বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের ক্রমবর্ধমান মৈত্রীও ভারতকে একরকম বাধ্য করেছে বাংলাদেশকে বাড়তি গুরুত্ব দিতে।

এই দৃষ্টিভঙ্গীর বদলটা ঠিক কী রকম, এক কথায় এর উত্তর দেন ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণা। তিনি বলেন, ‘তখন বাংলাদেশ ছিল শুধুই আমাদের ফ্রেন্ডলি নেবার (বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী) – কিন্তু এখন তারা ভেরি ভেরি ইম্পর্ট্যান্ট পার্টনার!’

২০১০ সালের জানুয়ারিতে যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শেষবার রাষ্ট্রীয় সফরে ভারতে এসেছিলেন, তখন এই এস এম কৃষ্ণাই ছিলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সোমবার রাতে যখন তাকে ফোনে পাওয়া গেল, চুরাশি বছরের এই প্রবীণ রাজনীতিক তখন গাড়িতে মহিসুর থেকে ব্যাঙ্গালোরের রাস্তায়। কিন্তু শেখ হাসিনার সফর নিয়ে কথা বলতে চাই শুনে এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন, আর জানালেন তার সময়ে ভারত-বাংলাদেশ যে যৌথ ঘোষণাপত্র জারি করেছিল,সেটাই কিন্তু তৈরি করে দিয়েছে এই অসামান্য সম্পর্কের ভিত।

সম্প্রতি তিনি নিজের পুরনো দল কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপি-তে যোগ দিয়েছেন, কিন্তু কংগ্রেস আমলেই যে দিল্লি-ঢাকার সম্পর্কের এই নতুন অধ্যায় লেখা শুরু হয়েছে সেটা স্বীকার করতে তার কোনও দ্বিধা নেই।

কিন্তু এত বছর বাদে শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের প্রাক্কালে কেন এটাকে ‘নতুন অধ্যায়’, ‘অসামান্য সম্পর্ক’ ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করতে হচ্ছে? এর উত্তরে ভারতের কূটনীতিক মহলের মতো কৃষ্ণাও বলছেন, গত কয়েক বছরে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ভেতর এমন কতগুলো সম্ভবনা তৈরি হয়েছে, কিছুকাল আগেও যা প্রায় অকল্পনীয় ছিল। সেগুলো অবশ্যই সম্পর্ককে বিশেষ মাত্রা দিয়েছে, কিন্তু গত বছর ঢাকায় চীনা প্রেসিডেন্টের সফর আর বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে দু’টি চীনা সাবমেরিনের সংযুক্তি ভারতকে বাংলাদেশ নিয়ে নতুন করে ভাবিয়েছে।

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বাংলাদেশকে যে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তার অঙ্গীকার করে গেছেন, তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো আর্থিক সক্ষমতা এই মুহূর্তে ভারতের নেই। তা সত্ত্বেও সাধ্যের সর্বোচ্চ সীমায় গিয়ে দিল্লি ৫ বিলিয়ন ডলারের লাইন অব ক্রেডিট বাংলাদেশকে দিতে চলেছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে চীনের সাবমেরিন কমিশনড হওয়ার পর দিল্লি ঢাকাকে এটাও বোঝাতে চেষ্টার ত্রুটি রাখছে না যে প্রতিরক্ষা খাতে তাদের সবচেয়ে স্বাভাবিক মিত্র হতে পারে ভারত – কখনোই চীন নয়।

এটা হতে পারে বাধ্যবাধকতার দিক। তবে গত সাত বছরে ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে এমন অনেক কিছু পেয়েছে, যা বাংলাদেশ সম্পর্কে দিল্লিতে ক্ষমতার অলিন্দে দারুণ একটা ‘পজিটিভ ভাইব’ (ইতিবাচক অনুরণন) তৈরি করেছে। দিল্লি এটা উপলব্ধি করেছে, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাতেই সেটা সম্ভব হয়েছে আর এই সহযোগিতার ধারাটা অব্যাহত রাখতে গেলে ভারতকেও এর উপযুক্ত প্রতিদান দিতে হবে। এই মনোভাবের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে নানা খাতেই।

এর কয়েকটা ক্লাসিক উদাহরণ হলো –

ক) কে ভেবেছিলেন ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে চার দশকের পুরনো স্থল-সীমান্ত সমস্যা মসৃণভাবে মিটে যাবে? ভারতের পার্লামেন্টে সেই বিলের বিরুদ্ধে একটাও ভোট পড়বে না – এটা তো আশার অতীত ছিল।

খ) এমন কী আন্তর্জাতিক সালিশির মাধ্যমে ভারত-বাংলাদেশ তাদের সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধও মিটিয়ে ফেলেছে কোনও তিক্ততা ছাড়াই।

গ) আলফা নেতা অনুপ চেতিয়া ২০১০ সালে বাংলাদেশের জেলে বন্দি ছিলেন – তাকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়ার পর আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাদের সঙ্গে সরকারের শান্তি আলোচনা চলছে জোর কদমে। দেশের উত্তর- পূর্বাঞ্চলে সশস্ত্র তৎপরতা একেবারেই স্তিমিত – আর সেখানেও সৌজন্যে বাংলাদেশ সরকার।

ঘ) সাত বছর আগে বাংলাদেশে লোডশেডিং পরিস্থিতি ছিল ভয়াবহ। কিন্তু এখন পশ্চিমবঙ্গের ভেড়ামারা বা ত্রিপুরার পালাটানা থেকেও বিদ্যুৎ আসছে, পরিস্থিতি অনেক সহনীয়। আর এই পালাটানা বিদ্যুৎকেন্দ্রের সব ভারী সরঞ্জামও গেছে আশুগঞ্জ নদীবন্দর দিয়েই, যার জন্য ভারত বাংলাদেশের কাছে খুবই কৃতজ্ঞ।

ঙ) কার্যত নীরব বিপ্লবই ঘটে গেছে দুদেশের কানেক্টিভিটি খাতে। ত্রিপুরার মানুষ কোনওদিন ভাবতেই পারেননি আগরতলা থেকে সরাসরি বাসে ঢাকা হয়ে কলকাতা পাড়ি দিতে পারবেন,অথচ সেটা এখন বাস্তব। ঢাকা থেকে পণ্যবাহী ট্রাক মাল নিয়ে ভারতে ঢুকে মাল খালাস করছে দিল্লির কন্টেনার টার্মিনালে, এটাও বাস্তব।

চ) ২০১৪ সালের অক্টোবরে বর্ধমানের খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণের পরই প্রথম সামনে আসে জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) জঙ্গিরা কতটা শিকড় বিছিয়েছে ভারতের ভেতরেও। জঙ্গীবাদ দমনে ঢাকা-দিল্লির যৌথ তৎপরতা তুঙ্গে উঠেছে তার পর থেকেই। জেএমবি-নব্য জেএমবি বা আইএস, যে নামেই তাদের ডাকা হোক না কেন – তাদের দমনে দুই দেশই কাজ করছে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে।

এমন উদাহরণ আরও অজস্র – আর এর সবই কিন্তু ঘটেছে মাঝের এই সাত বছরের মধ্যে। তিস্তা নিয়ে অপ্রাপ্তির অস্বস্তি নিশ্চয় আছে, কিন্তু তাতে এই অর্জনগুলোর গুরুত্ব খাটো হয়নি বলেই দিল্লির কূটনীতিকদের অভিমত।

আর সে কারণেই ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার ভিনা সিক্রি বলছেন, ‘গত এক দশকে ভারতের সঙ্গে এমন ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার উদাহরণ আপনি আর কোনও দেশের পাবেন না,এ কথা হলফ করে বলা যায়। সে কারণেই বাংলাদেশ সরকারের প্রতি দিল্লির মনোভাবও আমূল পাল্টে গেছে, দিল্লি এখন এটা আন্তরিকভাবে স্বীকার করে যে ‘দিস ইজ আ ভেরি স্পেশ্যাল রিলেশনশিপ!’

ভিনা সিক্রি এমন একটা সময় ঢাকায় রাষ্ট্রদূত ছিলেন যখন বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় – আর ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কও ছিল তলানিতে। ফলে সেখান থেকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে এই নাটকীয় পটপরিবর্তনটা সম্ভবত তার আরও বেশি করে চোখে লাগে। বাংলাদেশ যে এখন আর শুধু বন্ধু নয়, তারা ভারতের স্ট্র্যাটেজিক ও ইকোনমিক পার্টনারও হয়ে উঠেছে সেটাও নানা উদাহরণ দিয়ে দেখিয়ে দেন তিনি।

শেখ হাসিনা সরকারের ভারতের প্রতি এই দৃষ্টিভঙ্গী যে কতটা ‘সলিড’, তার প্রমাণ হলো বছরতিনেক আগে দিল্লিতে ক্ষমতার পালাবদলের পর যখন নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় এসেছে তার পরও সেই সম্পর্কে ক্রমাগত উন্নতি হয়েছে। অনেকে ভেবেছিলেন, কংগ্রেস বা তাদের ‘ফার্স্ট ফ্যামিলি’ গান্ধী পরিবারের সঙ্গে শেখ হাসিনার যেমন পারিবারিক ও ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা, তাতে বিজেপি ক্ষমতায় এলে দুদেশের সম্পর্ক হোঁচট খেতে পারে।

কিন্তু সেই ধারণা ভুল প্রমাণ করে দিল্লি প্রমাণ করে দিয়েছে, ঢাকার সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সেটা কোনও ফ্যাক্টরই নয়। শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির মধ্যে ব্যক্তিগত সমীকরণও খুব অল্প সময়ের মধ্যে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে।

ফলে সোয়া সাত বছর আগে দিল্লিতে এসে রাজধানীর এক পাঁচতারা হোটেলে যিনি চেক-ইন করেছিলেন, আর আগামী শুক্রবার দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনে যিনি ‘প্রিয় প্রণবদাদা’র আতিথ্য গ্রহণ করবেন – দিল্লির চোখে সেই দুই শেখ হাসিনা মোটেও এক নন।

সাত বছর আগের শেখ হাসিনার কাছে ভারতের প্রধান আশা ছিল ভারতের ‘বিচ্ছিন্নতাবাদীদের’ দমনে তিনি সাহায্য করবেন। সেই প্রত্যাশা কড়ায়-গন্ডায় পূর্ণ হওয়ার পর ভারতের এখন বড় চাওয়া হলো – তিনি যেন চীনের দিকে বেশি ঝুঁকে না পড়েন। তার জন্য যা যা করা দরকার, ভারত তা করার জন্যও প্রস্তুত।

ফলে শেখ হাসিনা ভারতের কাছে আজ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, অনেক কাঙ্ক্ষিত এক নেতা – যার কাছে তাদের প্রত্যাশা বিপুল, আবার যাকে সহায়তার জন্য তারা বাড়তি মাইলটুকু হাঁটতেও সানন্দে রাজি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top