সকল মেনু

১৪ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচারের গুলিতে নিহত ১০

রাকিবুল ইসলাম রাকিব: ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। মজিদ খানের ‘কুখ্যাত শিক্ষানীতি’ তার আগে থেকেই শিক্ষার্থীদের উত্তাল করে তুলেছে। ছাত্রসমাজ তা প্রত্যাখ্যান করে এবং ১৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ডাক দেয় ছাত্র জমায়েতের। সেদিন মিছিল নিয়ে হাইকোর্ট এলাকায় পৌঁছালে পুলিশ ব্যারিকেড দেয়। একসময় ব্যারিকেড ভাঙে শিক্ষার্থীরা, কাঁটাতারের ওপরে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা শুরু করেন ছাত্রনেতারা। আকস্মিকভাবে রায়ট কার ঢুকিয়ে গরম পানি ছিটানো শুরু করে পুলিশ। এরপর লাঠিচার্জ এবং নির্বিচারে গুলি। মিছিলে প্রথম গুলিবিদ্ধ হন জয়নাল। আহত জয়নালকে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে খুন করে পুলিশ। এরপর একে একে জাফর, কাঞ্চন, দীপালী সাহাসহ ১০ জন শহীদ হন।

তারপর থেকে দিনটি স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন হয়ে আসলেও নতুন করে পুরোনো তর্ক উঠে এসেছে প্রজন্মের সামনে। আশির দশকের ১৪ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচারের আদেশে রাজপথে ঝরে পড়েছিল ১০টি লাশ। নব্বইয়ের দশকে তা ধামাচাপা দেওয়া হলো ভালবাসা দিবসের নিচে। প্রশ্ন উঠছে, ভালবাসা দিবসের শক্তি কি শহীদের রক্তের চেয়ে লাল? যদি না হয়, দিনটিকে ভুলিয়ে দিতে ঘাতকের ষড়যন্ত্র সফল হলে ব্যর্থতার দায় প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলোর কিনা, তা নিয়ে কথা হয় সে সময়ে রাজপথে যারা ছিলেন সেই নেতাকর্মীদের সঙ্গে। তারা বলছেন, ক্ষমতায় আসতে রাজনৈতিক দলগুলোর স্বৈরাচারকে ব্যবহার ও বারবার আঁতাত করার কারণেই এই প্রতিরোধ চাপা পড়েছে। আর প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলো তাদের ভূমিকা নির্ধারণে ব্যর্থ হওয়ায় শূন্য মাঠে ভালোবাসা দিবসটাই প্রধান হয়ে উঠেছে নব্বই জুড়ে।

কী হয়েছিল ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বলতে গিয়ে আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালনকারী ছাত্রনেতা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘আমরা শুধু জয়নালের লাশ পাই। দিপালী সাহার লাশ গুম করে ফেলে। ১৫ ফেব্রুয়ারি কাঞ্চন চট্টগ্রাম শহরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। যাত্রাবাড়ী, মতিঝিলে অনেকে নিখোঁজ হন। কত জন নিহত হয়েছিলেন, তার কোনও হিসাব নেই।’

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির পর এটাই ছিল ইতিহাসে লিখে রাখার মতো ছাত্র বিক্ষোভের এবং নিপীড়নের ঘটনা। ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে যেতে বসা দিবসটি নিয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ও এক সময়ের ছাত্রনেতা কাবেরী গায়েন বলেন, ‘১৯৮৮ সালের মাঝামাঝি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই, তখন জয়নাল, জাফর, কাঞ্চন, দিপালী সাহাদের নামে স্লোগান শোনা যেত। তখনও বাম সংগঠনগুলো ক্যাম্পাসে যথেষ্ঠ শক্তিশালী ও প্রভাবশালী ছিল। কিন্তু ততো দিনে অন্য এজেন্ডা ছাত্র রাজনীতিতে স্থান করে নিয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এরশাদের পতনের পরে গণমাধ্যমের সংখ্যা বাড়লো, কিন্তু দেশের রাজনৈতিক প্রতিরোধ ইতিহাসের ওপর করপোরেট ঔদাসীন্য একুশে ফেব্রুয়ারির পরে ছাত্র-শিক্ষকের এমন তাৎপর্যময় বিশাল আন্দোলনকে বিস্মৃতির অতলে ঢেকে দিলো।’
শহীদ জয়নাল

আশির দশকের ছাত্রনেতারা বলছেন, ভালোবাসা দিবসে এ রকম একটা হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল, তা এ প্রজন্মকে স্মরণ করাতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। এ দায় স্বীকার করে নিতে আপত্তি নেই। ইতিহাসে অনেক ঘটনা আছে, পরবর্তী প্রজন্ম ভুলে গেলেও তারও পরবর্তী প্রজন্ম আবার খুঁজে বের করে।

আশির দশকের তুখোর ছাত্রনেতা বৃত্বা রায় দীপা  বলেন, ‘সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ লে জে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখল করে। সে সময়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনও প্রতিবাদ জারি রাখতে না পারলেও ছাত্রসমাজ পেরেছিল। এর মধ্যেই মজিদ খানের শিক্ষানীতি হলে ছাত্রসমাজ তা প্রত্যাখ্যান করে এবং ১৪ ফেব্রুয়রি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ডাক দেয় ছাত্র জমায়েতের। সেদিন মিছিলে প্রথম গুলিবিদ্ধ হন জয়নাল। একে একে জাফর, কাঞ্চন, দীপালী সাহা সহ ১০ জন শহীদ হন। স্বৈরাচারী সরকারের ভাষ্যমতেই, সেদিন গ্রেফতারের সংখ্যা ছিল ১হাজার১৩৩ জন। বস্তুত তা ছিল আরও অনেক বেশি।’


তিনি আরও বলেন, ‘সেই আত্মদান বিফলে যায়নি। গণরোষে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল মজিদ খানের ছাত্র স্বার্থবিরোধী শিক্ষানীতি। শহীদের আত্মদানের এই দিনটিকে ভুলিয়ে দিতে স্বৈরাচার ও সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ পোষ্য কিছু কুলাঙ্গার সে সময়ে এদেশে আমদানি করে ভ্যালেন্টাইনস ডে এবং নানা উছিলায় ছাত্র সমাজের কাছে তা জনপ্রিয় করে তুলতে প্রাণান্ত চেষ্টা করে। এই উদ্ভট প্রাণীগুলোকে সে সময়ে দেখেছি, রাস্তায় দাঁড়িয়ে লাল গোলাপ বিলাতে।’
সে সময় জাসদ ছাত্রলীগ কর্মী আকরামুল হক  বলেন, ‘প্রতিটি মিছিলে শিক্ষার্থীদের সরব উপস্থিতিই হার মানিয়েছিল স্বৈরশাসককে।’
এত বড় প্রতিরোধের কথা কেন পরবর্তীতে জিইয়ে রাখতে পারলো না ছাত্র সংগঠনগুলো প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য স্বৈরাচারের সঙ্গে আঁতাত করেছে দলগুলো। আর এর ফলে স্বৈরাচার আমলে যে নিপীড়ন এবং বিরাজনীতিকরণের প্রচেষ্টা ছিল, সেটি ধামাচাপা পড়ে গেছে। আশির দশকে রাশিয়ার সমাজতন্ত্রের বিবর্তনের পরে বিশ্বজুড়ে বাম রাজনীতিতে দুর্বল প্রভাব বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতিতেও পড়েছে। এর ফলে একানব্বইয়ের পর ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনগুলো পরিপক্ব হয়েছে এবং বাম ছাত্র রাজনীতি ক্ষয়িষ্ণু ধারায় পরিবর্তিত হয়েছে। যেহেতু তারা আর শক্তিশালী হয়নি, ফলে অবদান ধরে রাখতে কাজ করতে পারেনি।’

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top