সকল মেনু

অকারণেই বাড়ছে ওষুধের দাম!

d1552396b08e27e8ab23523f96c450ff-5855edb0693c3হটনিউজ২৪বিডি.কম : সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত মোয়াররফের জন্য প্রায় আট মাস ধরে ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট ‘ক্যালবো ডি’-এর কৌটা ১৫০ টাকা দিয়ে কিনছেন বাবা মোশাররফ হোসেন। কিন্তু গত দু’মাস ধরে একই কৌটা তাকে কিনতে হচ্ছে ২১০ টাকা দিয়ে। ঢাকার রমনা এলাকায় অবস্থিত রমনা ফার্মেসির সামনে ওষুধ কিনতে এসে এ প্রতিবেদককে তিনি জানান, ‘প্রতিমাসেযে ওষুধ কিনতে হয়, সে ওষুধের দাম যদি একলাফে ৬০ টাকা বেড়ে যায়, তাহলে আমাদের মতো নিম্ন-মধ্যবিত্ত ওষুধ কিনবে কীভাবে?’ কেবল এই একটি ওষুধই নয়, প্রতিটি ওষুধের দামই বেড়ে চলেছে অবিশ্বাস্যভাবে। বৃদ্ধ বাবার জন্য ‘বেক্সট্রাম সিলভার’ কিনতে এসে না কিনেই ফিরে যেতে হয় অদিতিকে। কারণ তিনি জানতেন ওষুধটির দাম ১৫০ টাকা। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮৫ টাকায়।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, প্রতিটি পরিবারের একাধিক সদস্য রয়েছেন যাদের নিয়মিত কয়েক ধরনের ওষুধ খেতে হয়। কিন্তু গত ছয় মাস ধরে ওষুধ কিনতে গিয়ে এক ধরনের বিভীষিকাময় দিন কাটাচ্ছেন তারা। ওষুধ না কিনে পারছেন না, আবার বাড়তি টাকার যোগান দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

ওষুধের দাম বাড়ার কারণ অনুসন্ধানে গিয়ে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর থেকে জানা গেল, ১ হাজার ৪০০টি জেনেরিকের ২৭ হাজার ব্র্যান্ডের ওষুধ তৈরি করা হয় দেশে। এর মধ্যে কেবলমাত্র ১১৭টি ওষুধের মূল্য সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা জানান, জীবনরক্ষাকারী ওষুধের তালিকা বৃদ্ধি (অ্যাসেনসিয়াল ড্রাগ) না পাওয়া এবং ওষুধ নীতি ২০০৫ কার্যকর না হওয়ার দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই ওষুধ কোম্পানিগুলো নিজেদের ইচ্ছামতো দাম নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাসোসিয়েশন থেকে জানা যায়, কোনও কোনও ওষুধের দাম ১০০ শতাংশ, কোনোটার দাম ৫০ শতাংশ, কোনও কোনোটার দাম বছরে দুই থেকে তিনবার বাড়ে। কোম্পানিগুলো তাদের সুবিধামতো দাম বাড়ায়। ২০ শতাংশের নিচে কোনও ওষুধের দামই বাড়ে না।

ওষুধের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির বিষয়ে অনুসন্ধানে জানা যায়, চলতি বছরের জুন থেকেই ওষুধ কোম্পানিগুলো ওষুধের দাম বৃদ্ধি করে চলেছে। এক্ষেত্রে রীতিমতো দাম বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা চলে কোম্পানিগুলোর মধ্যে। ক্যালসিয়াম, ঠাণ্ডাজনিত অসুখ, গ্যাস্ট্রিক, ডায়াবেটিস, আলসার এবং ঘুমের ওষুধের দাম সবচেয়ে বেশি বেড়েছে।

বাজার ঘুরে দেখা যায়, ২০১৪-১৫ সালে এক পাতার ‘ক্যালবো’ ট্যাবলেটের দাম ছিল ৪০ টাকা, যা এখন বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়, একইভাবে ‘ক্যালবো ডি’ ২০১৪-১৫ সালে ছিল ১৫০ টাকা, এখন বিক্রি হচ্ছে ২১০ টাকায়। ২০১৪-১৫ সালে প্রতি কৌটা ‘নিউরো-বি’ ছিল ১৫০ টাকা, এখন বিক্রি হচ্ছে ২৪০ টাকায়। বেক্সট্রাম গোল্ড এবং বেক্সট্রাম সিলভার ২০১৪ সালে ছিল ১৮০ টাকা, ২০১৫ সালে ২১০ টাকা এবং চলতি বছরে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয় ২৮৫ টাকা।

গতবছর ডায়াবেটিসের ওষুধ গ্যালভাসমেট ট্যাবলেটের দাম ছিল ৮৪৫ টাকা, চলতি বছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৪৫ টাকায়, একইভাবে ০.৫ মিলিগ্রামের ক্লোনিয়াম ট্যাবলেটের দাম ২০১৪-১৫ সালে ছিল ৪ টাকা করে যার দাম চলতি বছরে হয়েছে ৬ টাকা। ২ মিলিগ্রামের প্রতিটি ক্লোনিয়াম ট্যাবলেটের দাম ২০১৫ সালে ছিল ৬ টাকা, চলতি বছরে হয়েছে ১০ টাকা। ডিসোপাম প্রতিটির দাম ছিল গত বছর ৫ টাকা করে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে হয়েছে ৬ টাকা।

ভোল্টালিন ট্যাবলেটের প্রতি বক্সের দাম গতবছর ছিল ৪৮০ টাকা আর চলতি বছরে দাম বেড়ে হয়েছে ৫৮০ টাকা, ডেসলর ট্যাবলেট ৩০০ টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৪০০ টাকা। অপরদিকে, ২ মিলিগ্রামের ক্লোনাজিপাম গ্রুপের ৬০টি ট্যাবলেটের দাম ২০১৫ সালে ছিল ৩৬০ টাকা, যার দাম এখন ৬০০ টাকা, ১ মিলিগ্রামের দাম ৩০০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৪০০ টাকা।অপরদিকে, পটাশিয়াম বাইকার্বোনাইট ১২৫ টাকার সিরাপ বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকায়। শুধু তাই নয়, কমদামী বলে পরিচিত ওষুধগুলোর দামও বৃদ্ধি পাচ্ছে দেদারসে। ঠাণ্ডার ওষুধ হিসটাসিন, পিরিটনের দামও বেড়ে যাচ্ছে সমানতালে। এমনকি, ভিটামিন সি গ্রুপের নিউট্রিভিট সি এর দাম ২০১৪-১৫ সালে ছিল ১৩ টাকা করে এখন এর দাম ১৯ টাকা।

গত ৩০ বছর ধরে রাজধানীর রমনা এলাকায় ‘রমনা ফার্মেসি’ পরিচালনা করছেন গোলাম সারওয়ার। কিন্তু এই দীর্ঘ জীবনে ওষুধের দাম এর আগে এত ঘনঘন বৃদ্ধি পেতে দেখেননি বলে জানালেন তিনি। গত ছয়মাস ধরে অস্বাভাবিকহারে ওষুধের দাম বৃদ্ধিতে তিনি হতবাক। জানালেন, ১০ শতাংশ থেকে প্রায় ৯০ শতাংশের চেয়েও বেশি বেড়েছে কোনও কোনও ওষুধের দাম। গোলাম সারওয়ার হটনিউজ২৪বিডিকে বলেন, ‘কীভাবে কোম্পানি ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণ করে, এর জবাব সরকারকেই দেওয়া উচিত। একইসঙ্গে কোম্পানিগুলো কোন আইনে কোনও কারণ ছাড়াই ওষুধের ‍মূল্য বৃদ্ধি করে চলেছে, সেই বিষয়টিরও জবাবদিহিতা থাকা উচিত।’

বছরের কোন সময়টাতে বা কিসের ভিত্তিতে দাম বৃদ্ধি পায়, এ প্রসঙ্গে শান্তিনগর এলাকার ‘নোয়াখালী ওষুধ ঘর’-এর কিবরিয়া মাহমুদ হটনিউজ২৪বিডিকে বলেন, ‘ওষুধের দাম বৃদ্ধির কোনও সুনির্দিষ্ট কারণ বা সময় কখনও দেখিনি। মাস শেষ হবার একদিন আগে এসে তারা জানিয়ে যায়,পরবর্তী মাসের প্রথম থেকে ওষুধের দাম বেড়ে যাবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সরকারিভাবে কিংবা মিটফোর্ড এলাকায় ওষুধের পাইকারি বাজার থেকে আমরা এসব ওষুধের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি জানতে পারি। সরকার বেশিরভাগ ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণ করে না, দামের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে ওষুধ কোম্পানিগুলো। আর কিছু কিছু ওষুধ কেবল নিয়ন্ত্রণ করে ওষুধ প্রশাসন।

একাধিক ফার্মেসিতে কর্মরত ওষুধ বিক্রেতা এবং ফার্মেসি মালিকদেরদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কোম্পানিগুলো ওষুধের কাঁচামাল সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, ভারতসহ নানা দেশ থেকে নিয়ে আসে, এমন যুক্তিতে ওষুধের দাম নির্ধারণ করে থাকে বলে তাদেরকে জানানো হয়। ‘রমনা ফার্মেসি’-র মালিক সারোয়ার আলম বলেন, ‘গত জুন মাস থেকেই ওষুধের দাম কয়েকদফা বেড়েছে, এখনও বেড়েই চলছে। কোনও কোম্পানি তাদের একটি দাম বাড়ালে আরেক কোম্পানি তাদের আরেকটি ওষুধের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। আর এভাবে প্রায় সব ধরনের ওষুধের দামই বৃদ্ধি পাচ্ছে। যাতে করে সাধারণ মানুষের হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে জীবন রক্ষাকারী এসব ওষুধের দাম।

স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন জাতীয় কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ ই মাহবুব হটনিউজ২৪বিডিকে বলেন, ‘অ্যাসেনশিয়াল ড্রাগের বাইরে যে ওষুধ রয়েছে, সেগুলোর মূল্য নির্ধারণ করে ওষুধ কোম্পানিগুলো। আর তারা সেটা করে থাকে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে। এই মূল্য নির্ধারণ করার সময়ে ফার্মেসি ইন্ড্রাস্ট্রির প্রতিনিধিরা সেখানে থাকেন। কিন্তু বিশ্বের অন্যকোনও দেশে ফার্মেসি ইন্ড্রাস্ট্রির প্রতিনিধিরা সেখানে থাকে না।’

তিনি আরও জানান, “এ বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমরা ‘ওষুধ নীতি ২০০৫’ দিয়েছি, কিন্তু সেটি মন্ত্রণালয়ে পড়ে রয়েছে। তার কোনও কার্যকারিতা নেই। আর জীবন রক্ষাকারী (অ্যাসেনসিয়াল ড্রাগ) যেসব ওষুধ রয়েছে তার তালিকা যদি সরকার বড় করে দিত, তাহলে সেটি সরকারই নিয়ন্ত্রণ করতে পারত।”

অধ্যাপক মাহবুব বলেন, ‘ওষুধ নীতি ২০০৫ যত দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে সাধারণ মানুষের জীবন রক্ষাকারী ওষুধ নিয়ে দুর্বৃত্তায়ন কিছুটা হলেও কমবে।’

অপরদিকে, ১১৭টি জীবনরক্ষাকারী ওষুধের মূল্য সরকার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এটা সরকারের পলিসি আর বাকিগুলোর মূল্য স্ব স্ব প্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করে থাকে বলে জানান ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিচালক মো. রুহুল আমিন। তিনি আরও বলেন, ‘ওষুধের দাম বেড়েছে অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে মূল্য সনদ প্রাপ্তির জন্য কোম্পানিগুলো যখন ওষুধ প্রশাসনে আবেদন দাখিল করে, তখন এই মূল্যগুলোর সনদ দেওয়া হয় অন্যান্য কোম্পানিগুলোর ওই জেনারিকের ওষুধগুলোর দাম কেমন সেটার সঙ্গে মিল রেখে। কোম্পানিগুলো দাম বৃদ্ধির জন্য কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি, পরিবহন খরচ, জ্বালানির দাম বৃদ্ধিসহ নানা কারণ দেখিয়ে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করে তারা।’ তবে রুহুল আমিনের দাবি, ‘কোম্পানিগুলোর ওষুধের মূল্য বৃদ্ধির প্রবণতা একটু হলেও কমছে।’

ওষুধের দাম কোম্পানিগুলো ইচ্ছা করে বাড়ায়নি দাবি করে ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব এসএম শফিউজ্জামান বলেন, ‘আমাদের ওষুধের কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। যেগুলো বিভিন্ন প্ল্যান্ট থেকে আসে। কিন্তু কখনও সেসব প্ল্যান্টের ঘাটতি হলে, জ্বালানি মূল্য, পরিবহন খরচসহ অন্যান্য অনেক কিছুর কারণে ওষুধের দাম স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যায়। তবে গত তিনমাস ধরে কোনও ওষুধের মূল্য বৃদ্ধি পায়নি এবং সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ডিসেম্বর পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবেও না।’

এসএম শফিউজ্জামানের মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে অনুসন্ধানে পাওয়া যেসব ওষুধের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে, সেগুলোর কথা জানালে তিনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন, ‘এগুলো হয়তো আমাদের এই সিদ্ধান্তের আগে আবেদন করা হয়েছিল, তাই দাম বেড়েছে।’

এদিকে, ওষুধের দাম বৃদ্ধির জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনকে দায়ী করেন কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি মো.আব্দুল হাই। তিনি হটনিউজ২৪বিডিকে বলেন, ‘‘১৯৯৪ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বলা হয়, অ্যাসেনসিয়াল ড্রাগ ছাড়া বাকি সব ওষুধের দাম নির্ধারণ করবে প্রস্তুতকারক কোম্পানি। আর তারাই সবকিছু ঠিক করে দিয়ে কেবলমাত্র ভ্যাট দেওয়ার জন্য ওষুধ প্রশাসন থেকে এর অনুমোদন নেবে।’ ওষুধ প্রশাসন কেবল সেখানে সই করে ছেড়ে দেয়। কিন্তু সমস্ত ক্ষমতা কোম্পানিগুলোর হাতে’’, বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন আব্দুল হাই। তিনি আরও বলেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওই প্রজ্ঞাপনের বলেই সবকিছু হয়ে থাকে। কারও কোনও জবাবদিহিতা নেই। এমনকি ওষুধের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে একটা মূল্য নির্ধারণ কমিটি আছে। কিন্তু তাদেরকে কোথাও ডাকা হয় না। কোম্পানিগুলোকে সরকার ক্ষমতা দিয়েছে দাম বাড়ানোর, আর তারা ইচ্ছামতো দাম বাড়ায়।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ওষুধ বিক্রেতা জানান, ‘ওনারা (ওষুধ শিল্প সমিতি) স্রেফ ডাকাতি করে যাচ্ছেন। মানুষ খাবার না খেয়ে থাকতে পারে, কিন্তু যেভাবেই হোক ওষুধ তাকে কিনতেই হয়। আর এ সুযোগটাই নিচ্ছেন ওনারা।’

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top