সকল মেনু

কালোমুখো হনুমান খাদ্যের অভাবে বিলুপ্তির পথে

unnamed কেশবপুর থেকে ফিরে যশোর প্রতিনিধি, আব্দুল ওয়াহাব মুকুল : যশোরের কেশবপুর উপজেলায় বসবাসরত পৃথিবীর এক মাত্র বিরল প্রজাতির কালোমুখো হনুমান আজ খাদ্য ও প্রয়োজনীয় অভয়ারণ্যের অভাবে বিলুপ্তির পথে। হনুমানের জন্য সরকারী ভারে পর্যাপ্ত পরিমান খাদ্য বরাদ্ধ দেওয়া হলেও অসাধু সরবরাহ ও গ্রহনকারীর লুটপাটের কারনে সময় মত খাবার না পেয়ে ক্ষুধার্ত এই কালোমুখো হনুমানগুলো নিজের জীবন বাঁচাতে খাদ্য আহরনে বাধ্য হচ্ছে কেশবপুর ছাড়তে।
যশোর জেলা শহর থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরের কেশবপুর উপজেলা সদরে পৌছালে শহরেই মিলবে বিরল প্রজাতির কালোমুখো হনুমান। রামায়ণের ”রামভক্ত হনুমান দলকে ঘিরে যশোরের কেশবপুর উপজেলা পৃথিবীর বুকে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার বদৌলতে আজ সুপরিচিত জনপদ। কিন্তু যাদের নিয়ে আজকের এ পরিচিতি সেই কালোমুখো হনুমানের দল আজ ভালো নেই। সরকারিভাবে খাদ্যের ব্যবস্থা করা হলেও খাদ্য সরবরাহ ও গ্রহনকারীর লাগামহীন লুটপাট, প্রয়োজনীয় অভয়ারণ্য না থাকায় তাদের বসবাস ও প্রজনন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে যেতে শুরু করেছে। দূর-দূরান্ত থেকে অনেকেই কেশবপুরে এসে থাকেন কালোমুখো হনুমান দেখতে। তারা নিজ হাতে তাদেরকে বাদাম, বিস্কুট ও কলা খেতে দিয়ে আনন্দ পান।
মানুষের সাথে এদের রয়েছে পরম সখ্যতা, খাদ্যের সন্ধানে এরা লোকালয়ে ঘুরে ফিরে মানুষের হাত থেকে খাদ্য চেয়ে নেওয়া, সুযোগ পেলে দোকান থেকে হাত বাড়িয়ে বিস্কুট, কলা, রুটি নিয়ে চলে যায়। তারপরও ব্যবসায়ীরা এদের উপর বিরক্ত হন না। কেশবপুরের বিরল পওজাতির কালোমুখো হনুমানের সাথে মানুষের রয়েছে বিশেষ সখ্য। কেশবপুর উপজেলা বন কর্মকর্তার অফিস সূত্র জানায়, কেশবপুরে সরকারি হিসেবে হনুমানের সংখ্যা সাড়ে ৩ শ। কিন্তু বাস্তবে কেশবপুরে সাড়ে ৫শ হনুমান রয়েছে। এরা ৯ থেকে ১০ টি গ্রুপে ভাগ হয়ে বিচরণ করে থাকে। মানুষের সাথে বন্ধুত্ব সুলভ আচরণ করে। কেশবপুর পুরাতন বাস স্ট্যান্ডের সাধন টি স্টলের মালিক সাধন সাহা, ভানু চক্রবর্ত্তী জানান, হনুমানরা খাদ্য অন্বেষণে এসে ক্ষতি করলেও তাদের রয়েছে প্রচন্ড অনুভুতি শক্তি।
হনুমানের দলবদ্ধ হয়ে চলাফেরা করে। হনুমানের স্বভাবগত বৈশিষ্ট হচ্ছে এরা গ্রুপ ভিত্তিক চলাফেরা করে থাকে। এক একটি গ্রুপের নেতৃত্বদেয় একটি করে পুরুষ হনুমান। কেশবপুরের মানুষের মন্তব্য, দলের প্রধান পুরুষ হনুমান অত্যন্ত বদমেজাজি। দলের মধ্যে যদি কোন মা হনুমান পুরুষ বাচ্চা প্রসব করে তাহলে আর রেহাই নেই। যে ভাবেই হোক সে বাচ্চাকে মেরে ফেলবে ওই পুরুষ হনুমানটি। আর এ ধরনের আচরণের কারণ আনুসন্ধানে জানা যায়, দলনেতা পুরুষ হনুমানটির বধ্যমূল ধারনা পুরুষ শাবকটি বড় হয়ে তার কর্তৃত্ব নিয়ে নিতে পারে, আর সে আশঙ্কায় এ ধরনের আচরণে করে থাকে দলনেতা।
প্রাণি বিজ্ঞানীদের মতে, এ প্রজাতি সাধারণত ৫ বছর বয়স থেকে ৬ মাস অন্তর বাচ্চা প্রসব করে থাকে। এদের গড় আয়ু ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। এক একটির ওজন ১০ থেকে ৩০ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। হাত ও পায়ের পাতা মুখের মতোই কালো। শরীরে ধূসর বণের রোম (লোম) দিয়ে আচ্ছাদিত। তবে পেটের দিকটা কিছুটা সাদা ও লালাভ। চলাফেরা করার সময় এরা লেজ উচু করে চলে। হনুমানেরা কেশবপুর উপজেলা পরিষদের সামনে, পশুসম্পদ কার্যালয়ের পিছনে, কেশবপুর খাদ্যগুদাম এলাকা, রামচন্দ্রপুর, আলতাপোল, ব্রম্মকাঠি, বালিয়াডাঙ্গা, মধ্যকুল, সাহাপাড়া, মুজগুন্নি, ব্রহ্মকাঠি, ভোগতি গ্রাম ও  কেশবপুরের বিভিন্ন এলাকা  দিয়ে এরা স্বাভাবিক চলাফেরা করে থাকে।
সরকারীভাবে প্রতিদিন খাদ্য সরবরাহ করা হলেও বরাদ্দকৃত খাদ্য প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল হওয়া ও ঠিকাদারের দুর্নীতির কারণে খাদ্য অন্বেষণে হনুমান কলা বোঝাই ট্রাক, পিকআপ যোগে দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে যায়। ইতিমধ্যে ঝালকাঠি, পিরোজপুর, পাইকগাছা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, ঝিনাইদহ, মাগুরাসহ বিভিন্ন স্থানে হনুমান খাদ্য অন্বেষণে গিয়ে কেশবপুরে ফিরে আসেনি। অনেক স্থানে নির্যাতনে মৃত্যুও হয়েছে, যা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
কেশবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, খাদ্য অন্বেষণে দেশের বিভিন্নস্থানে চলে যাওয়া হনুমানদের সেখানকার বন কর্মকর্তারা জানতে পারলে তারা পিআপযোগে কেশবপুরে এনে আমার ও বন কর্মকর্তার কাছে হনুমানটিকে হস্তান্তর করে থাকেন। এরপর আমি পার্শ্ববর্তী বনে হনুমানটিকে অবমুক্ত করি।
কেশবপুর থানার পাশের এক ব্যক্তি হনুমানের লেজে কোপ দিয়ে জখম করায় হনুমানদল ঐক্যবদ্ধ হয়ে থানা কর্তার বাসভবন ঘেরাও করে বিচার প্রার্থনা করে। অগ্যতা সে ব্যক্তিকে পুলিশ আটক করতে বাধ্য হয়। আটকের পর তারা থানা কম্পাউন্ড ত্যাগ করে। এদের মধ্যে রয়েছে দৃঢ় ঐক্য। এছাড়া ঢাকাগামী একটি পরিবহনের চাকায় পিষ্ট হয়ে একটি হনুমানের মৃত্যু হলে তারা সড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালনও করে থাকে। কেশবপুর থানার অফিসার ইনচার্জ সহিদুল ইসলাম ও ওসি তদন্ত শেখ মাসুদুর রহমান জানান, কেশবপুরের হনুমানদের নিয়ে অনেক কাহিনী তিনি শুনেছেন। তবে এরা অত্যন্ত বন্ধুসূলভ আচরণে অভ্যস্থ। এরা থানা কম্পাউন্ডে আসলে কলা, বিস্কুট দেয়া হয়। অনেক সময় তাদের খাদ্য দিতে একটু দেরি হলে অফিসের ভিতরে প্রবেশ করে।
কেশবপুরের বিরল প্রজাতির কালোমুখো হনুমান রক্ষায় সরকারিভাবে বরাদ্দকৃত খাদ্য সঠিকভাবে বিতরণ করা হচ্ছে কিনা বা তাদের কোন সুবিধা-অসুবিধা দেখভালের জন্য রক্ষণাবেক্ষণে তদারকি কমিটি রয়েছে। যার নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন কেশবপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শরীফ রায়হান কবীর জানান, হনুমানদের জন্য সরকারিভাবে খাদ্য বরাদ্দ চলছে। তবে সরকারিভাবে মাঝে মধ্যে কিছুদিনের জন্য খাদ্য বরাদ্ধ বন্ধ হলে, জেলা প্রশাসন থেকে তাদের খাদ্য সরবরাহ করা হয়। ২০১৩ সালের ১৫ আগস্ট থেকে সরকারের জীব বৈচিত্র সংরক্ষণ ও ইকোটুরিজম উন্নয়ন প্রকল্পে কেশবপুরের হনুমানের জন্য সরকারিভাবে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে নিরাপদ বিচরণে তাদের জন্য অভয়ারণ্য সৃষ্টি করার কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top