সকল মেনু

আওয়ামী লীগ : ইতিহাস, সংগ্রাম ও ঐতিহ্য শীর্ষক সেমিনারের মূল প্রবন্ধ

published-pic3_38545হটনিউজ২৪বিডি.কম : বাংলাদেশ  আওয়ামী লীগ এ দেশের একটি অনন্য অসাধারণ রাজনৈতিক দলের নাম।  আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ৬৭ বছরের সংগ্রামী ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পতাকাবাহী একটি প্রতিষ্ঠান। ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠা থেকে আজ অবধি নিরবিচ্ছিন্নভাবে বাঙালির সমাজ-রাজনীতি-সংস্কৃতির মূলধারা সমন্বয়, সমতা ও সম্প্রীতির আদর্শকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বহতা নদীর মতো ধারণ করে চলেছে। স্বাধীনতাসহ জাতির যা কিছু শ্রেষ্ঠ অর্জন, এর সিংহভাগ কৃতিত্ব এ দলের। জাতির পিতার নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেই এ দল থেমে থাকেনি, এ রাষ্ট্রের সার্বিক গঠন-গড়নে শুরু থেকে একচ্ছত্র নেতৃত্ব দিয়ে আজ জাতির জনকেরই সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ ও সৃজনশীল (Creative) নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে বর্তমান পর্যায়ে তুলে এনেছে দুর্বার- এক অভাবনীয় উচ্চতায়, যা সারাবিশ্বের জন্য আজ এক বড় বিস্ময়।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র এক বছর দশ মাসের মধ্যে বিরোধী রাজনৈতিক দল গঠন কিছুতেই সহজসাধ্য ছিল না। মুসলিম লীগ সরকারের রক্তচক্ষুর ভয়ে সেদিন ঢাকা শহরের কোথাও কেউ  সরকার-বিরোধী রাজনৈতিক কর্মী সম্মেলনের জন্য হলরুম ভাড়া বা জায়গা দিতে সম্মত হননি । অবশেষে উদ্যোক্তাদের ঠাঁই হলো পুরান ঢাকার কে এম দাস লেনের কে এম বশির (হুমায়ুন সাহেব নামে পরিচিত)-এর ‘রোজ গার্ডেন’ বাগান বাড়িতে। বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিম সমর্থক প্রগতিশীল অংশের এ কর্মী সম্মেলনের (২৩ ও ২৪ শে জুন ১৯৪৯) উদ্যোক্তাগণ সকলেই কি সেদিন জানতেন বা বুঝতে পেরেছিলেন ইতিহাসের কী বীজ তাঁরা সেখানে বপন করছেন?  সবাই বা অনেকে না হলেও অন্তত একজন সেটি জানতেন আর তিনি হলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা ও স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কারাবন্দি অবস্থায় তিনি ছিলেন এর  প্রতিষ্ঠিতা যুগ্ম-সম্পাদক। তখন বঙ্গবন্ধুর  বয়স মাত্র ২৯ বছর। তবে অচিরেই তিনি পরিণত হন এর প্রাণশক্তি রূপে। ১৯৫৩ সালেই পুরান ঢাকার মুকুল সিনেমা হলে ৩-৫ই জুলাই অনুষ্ঠিত দলের কাউন্সিলে তাঁর সাংগঠনিক রিপোর্ট পেশ কালে তিনি এই মর্মে ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন,
আমাদের এই মহান কাউন্সিল অধিবেশন সাংগঠনিক ও অন্যান্য ব্যাপারে এমন গভীর বাস্তব ধর্মী সিদ্ধান্ত করিবে যে, উহা আমাদের সংগঠনকে উদ্দীপিত … করিয়া বর্ত্তমান ও ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক দুনিয়ার জন্য এক অমর ইতিহাস সৃষ্টি করিবে। ১

ইতিহাস কি? ইতিহাস জীবন ও জগৎ সম্পর্কীত জ্ঞানের এক বিশেষ শাস্ত্র। জীবনের মতোই তা চলমান। ঘটনা ইতিহাসের বিষয় বা উপাত্ত। তবে যা ঘটে বা আমরা যা বলি, করি কিংবা লিখি তা-ই ইতিহাস নয়। ইতিহাস সত্যানুসন্ধিৎসু। কালের পরীক্ষায় যা টিকে থাকে, অন্য কথায়, যা কালোত্তীর্ণ, তা-ই ইতিহাস। ইতিহাস সত্যের নির্যাস।

আওয়ামী লীগ আমাদের ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। শুধু অংশ বা বিষয়বস্তু বলা যথেষ্ট নয়, ইতিহাসের স্রষ্টা, নির্মাতাও। আওয়ামী লীগের ভূমিকার এ পাল্লাই ভারী। এক ঐতিহাসিক প্রয়োজনে এর প্রতিষ্ঠা। বাঙালির হাজার বছরের স্বতন্ত্র জাতিসত্তার গঠন-গড়ন প্রক্রিয়ার ভেতর থেকে গড়ে ওঠা স্বাধীনতার স্বপ্ন, সংগ্রাম, লড়াই বা জাতির সার্বিক মুক্তির আকাক্সক্ষা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পকিস্তানি পর্বে মূর্ত হয়ে চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। সৃষ্টি হয় বাংলাদেশ বিপ্লব ১৯৭১। প্রতিষ্ঠা পায় স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র, বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু বাঙালির এ ইতিহাসের মহানায়ক। আর যে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সকলকে একই প্লাটফরমে ঐক্যবদ্ধ করে বাঙালির জাতির ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন, স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, এর নাম আওয়ামী লীগ।

৪৮ ও ৫২-র ভাষা-আন্দোলন, ৫৪-র যুক্তফ্রণ্ট নির্বাচন, ৬০-এর দশকে আইয়ুব-বিরোধী আন্দোলন, ৬২ ও ৬৪-র শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট-বিরোধী আন্দোলন, ৬৬-র ৬-দফা, ৬৮-র আগরতলা রাষ্ট্রদ্রোহিতা মামলা, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও আইয়ুবের পতন, ৭০-এর নির্বাচন, ৭১-এর ২-২৫ মার্চ অসহযোগ আন্দোলন, ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৬শে মার্চ ১৯৭১ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা, ১০ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকার নামে পরিচিত প্রথম বাংলাদেশ সরকার গঠন ও স্বাধীনতার সংবিধানিক ঘোষণা, ১৭ই এপ্রিল সরকারের প্রকাশ্যে শপথ গ্রহণ, ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ, ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধে বিজয়, যুদ্ধ শেষে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সেনা সদস্যদের সেদেশে প্রত্যাবর্তন, যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশের পুনর্গঠন-পুনর্বাসন, নতুন রাষ্ট্রের সংবিধান রচনা, বিশে^র রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভ, কমনওয়েলথ, জাতিসংঘ, ওআইসি-সহ আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ, ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্ট জাতির জনককে সপরিবার নির্মম হত্যা-পরবর্তী জিয়া-এরশাদের সেনা শাসন, পরবর্তীতে বেগম খালেদা জিয়ার বিএনপি এবং আরো পরে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-আদর্শ জাতীয়-রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পুনঃপ্রতিষ্ঠার দীর্ঘ সংগ্রাম, বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচার ও রায় কার্যকর করা, ৭১-এ পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সহযোগী, মানবতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী খুনিচক্রের বিচার অনুষ্ঠান ও বিচারের রায় কার্যকর করা, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি (২রা ডিসেম্বর ১৯৯৭), ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি (১৭ই নভেম্বর ১৯৯৯), খাদ্যে স্বয়ংস্পূর্ণতা অর্জন, নারীর ক্ষমতায়ন, যোগযোগ ব্যবস্থার অভূত উন্নয়ন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ, জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি (৬.৫ ), মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি (৭১ বছর উর্ধ্ব),২ চরম দারিদ্র্যের হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস (১২.৯ শতাংশে নেমে আসা), রেকর্ড পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ (৩১ বিলিয়ন ইউএস ডলার), নিরক্ষরতা দুরীকরণে  অগ্রগতি (বর্তমান সাক্ষরতার হার প্রায় ৭১ ভাগ), সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ দমন, উন্নয়নে অধিকহারে বিজ্ঞান ও তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার  বা ডিজিটাল বাংলাদেশ ইত্যাদি পাকিস্তান ও বাংলাদেশ পর্বের এ যাবৎ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক ঘটিনা ও অর্জন। আওয়ামী লীগ ব্যতিরেকে এর কোনো কিছুই কি ভাবা সম্ভব? এর সব কিছুই বঙ্গবন্ধু ও তাঁর কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগেরই অর্জন। আর যা কিছু আওয়ামী লীগের অর্জন, তা অনিবার্যভাবে এ দেশের জনগণের অর্জন। ‘আওয়ামী’ অর্থ জনগণ আর ‘আওয়ামী’ থেকে আওয়ামী লীগ। এ দেশের জন-গণ-মন নন্দিত দলের নামই হচ্ছে আওয়ামী লীগ।

পুরান ঢাকার রোজগার্ডেনে প্রতিষ্ঠা হলেও, আওয়ামী লীগের চলার পথ কখনোই কুসুমাস্তির্ণ ছিল না। উল্লিখিত কোনো সাফল্য বা অর্জনই আলোচনার গোলটেবিলে অর্জিত হয়নি, এ জন্য প্রয়োজন হয়েছে কঠিন আন্দোলন-সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ। ৪৮-এর ভাষা-আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন প্রথম কারাবন্দিদের অন্যতম।৩ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আওয়ামী লীগের পূর্বসূরি ছাত্রলীগেরও অনেক নেতা-কর্মী সেদিন কারাবরণ করেছিলেন। ভাষা-আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্ব অর্থাৎ ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বন্দি অবস্থায় বঙ্গবন্ধু কারা অভ্যন্তরে দীর্ঘ অনশনরত। ৫৪ সালের যুক্তফ্রণ্ট মন্ত্রিসভা দুই মাসেরও কম সময়ের মধ্যে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক বাতিল ঘোষিত হওয়ার পরপর ঐ মন্ত্রিসভার মন্ত্রীদের মধ্যে একমাত্র বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খানের মার্শাল ল’ জারির পর পুনরায় তিনি গ্রেপ্তার হন। ১৯৬৬ সালে বাঙালির জাতীয় মুক্তির সনদ ‘আমাদের বাঁচার দাবী’ খ্যাত ঐতিহাসিক ৬-দফা কর্মসূচি গ্রহণ ও তা প্রচারকালে বঙ্গবন্ধুকে প্রথম ৩ মাসে ৮ বার গ্রেপ্তার,৪ এরপর ৮ই মে ১৯৬৬ চূড়ান্তভাবে গ্রেপ্তার করে ঢাকার ক্যান্টনমেন্টে আগরতলা রাষ্ট্রদ্রোহিতা মামলায় বিচারের সম্মুখীন করা হয় এবং দীর্ঘ প্রায় ৩ বছর একটানা কারাগারে ফাঁসির ঝুঁকি নিয়ে কাটানোর পর ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুবের পতনের মাধ্যমে তাঁর ও মামলায় অভিযুক্ত অন্যদের নিঃশর্ত মুক্তিলাভ সম্ভব হয়। এরপর পাকিস্তানের নতুন সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়ার অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করার পরও কীভাবে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত এবং কয়েক লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হয়, সে ইতিহাস সকলের জানা। পাকিস্তানের ২৪ বছরের ১২ বছরই বঙ্গবন্ধুকে কারাগারের অন্ধকার প্রকষ্ঠে কাটাতে হয়। বঙ্গবন্ধুর জন্য সমগ্র পাকিস্তানটিই ছিল বৃহৎ কারাগার।

এ আন্দোলন-সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর সম্বল ছিল তিনটি। এক. বাঙালির জাতীয় মুক্তি বা স্বাধীনতা অর্জনে যে-কোনো ত্যাগ স্বীকারে তাঁর সর্বোচ্চ অঙ্গীকার। দুই. আওয়ামী লীগের নিবেদিতপ্রাণ কর্মী ও ইস্পাত দৃঢ় সংগঠন। তিন. বঙ্গবন্ধুর প্রতি এদেশের জনগণের সর্বাত্মক সমর্থন, গভীর আস্থা ও অফুরন্ত ভালোবাসা। আওয়ামী লীগের শুরু থেকে দীর্ঘ ২৫ বছর যাবৎ প্রতিষ্ঠাকালে এর যুগ্ম-সম্পাদক, এর কিছু সময় পর ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক (১৯৫২-১৯৫৩), ১৯৫৩-১৯৬৬ (ফেব্রুয়ারি) এ সময়ে ১৩ বছর সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৬৬ (মার্চ)-১৯৭৪ (জানুয়ারি) পর্যন্ত ৮ বছর দলের সভাপতি থাকা অবস্থায় তিনি দলকে এমনই শক্তিশালী ভিত্তির ওপর গড়ে তুলেছিলেন যে, বাংলাদেশে এমন একটি পরিবার পাওয়া কঠিন যে পরিবারে আওয়ামী লীগের একজন সদস্য বা সমর্থক নাই। সুদূরপ্রসারী এক লক্ষ্য নিয়েই বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগকে গড়ে তুলেছিলেন। ১৯৫৫ সালে পুরান ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে সাধারণ সম্পাদককের রিপোর্টে বঙ্গবন্ধু সংগঠনের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করে ঘোষণা করেছিলেন,
… আওয়ামী লীগকে দৃঢ় সংগঠনের উপর দাঁড় করিয়ে একটি সত্যিকার জাতীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার কাজকেই আমরা প্রধানতম কর্তব্য বলে মনে করি। … ইতিমধ্যে প্রদেশের সকল জেলায় এবং  শতকরা ২৫ ভাগ ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ সংগঠন হয়েছে। ইনশা আল্লাহ অদূর ভবিষ্যতে আমরা প্রদেশের সকল ইউনিয়নে এমনকি সকল গ্রামেই আওয়ামী লীগের ঝাণ্ডা উড়াতে সক্ষম হবো।৫
মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী ন্যূনতম সময়ের মধ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠন-পুনর্বাসন সম্পন্ন করে বঙ্গবন্ধু যে মুহূর্তে সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের একটি শক্তিশালী ভিত রচনা ও এর সার্বিক উন্নয়নে মনোনিবেশ করলেন, ঠিক তখনই মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত দেশি-বিদেশী চক্রের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রে সংঘটিত হয় বাঙালির জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে মর্মান্তিক, ১৫ই আগস্ট ট্র্যাজেডি। এরপর মোশতাক-জিয়া-এরশাদ-বেগম খালেদা জিয়া ও বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলে এ দেশে মুক্তিযুদ্ধে পরিত্যক্ত সেই পাকিস্তানি সেনা-আমলা শাসন ও সাম্প্রদায়িক ধারার পুনঃপ্রত্যাবর্তন ঘটে। হত্যা, ক্যু, পাল্টা ক্যু’র মাধ্যমে ক্ষমতা দখল বা দখলের চেষ্টা, ভোটাধিকারসহ জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ, নির্বাচন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়া, নিষিদ্ধ থাকা ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক দলের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, সংবিধানের প্রস্তাবনাসহ চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে পরিবর্তন, বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের সরকারি আশ্রয়-প্রশ্রয়দান ও বিভিন্ন পদে আসীন, শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম-কে পাকিস্তানি পাসপোর্টে বাংলাদেশে আসার অনুমতি,  তাকে এ দেশে  বসবাস ও রাজনীতি করার সুযোগ দান, সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষণা,  মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী করা, দুই যুদ্ধাপরাধী নিজামী ও মুজাহিদকে মন্ত্রী বানিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তস্নাত বাংলাদেশের পতাকা তাদের হাতে তুলে দেয়া, ৭১-এর ঘাতক-খুনি ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা, অনেক সংগ্রামের বিনিময়ে অর্জিত নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ওপর দলীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার হীন চেষ্টার মাধ্যমে এর মূল উদ্দেশ্য নস্যাৎ, ধর্মের নামাবলি পরিহিত উগ্র সন্ত্রাসী বা জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রতি পৃষ্ঠপোষকতা দান ইত্যাদি এদের শাসন আমলের বৈশিষ্ট্য।

১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির জন্য যেমনি, তেমনি রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের জন্য ছিল এক মহাবিপর্যয়কর ঘটনা। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে পরবর্তী ধাপে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বদানে যারা সক্ষম ছিলেন তাঁরা হলেন তাঁরই ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহচর জাতীয় চার নেতা। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার তিন মাসেরও কম সময়ের মধ্যে ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি অবস্থায় একই খুনিচক্র তাঁদেরও বর্বরোচিতভাবে হত্যা করে। এদিকে ১৯৭৬-১৯৭৭ সালে আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠিত করার প্রক্রিয়ায় দলের অভ্যন্তরে দেখা দেয় নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব।৬ ১৯৮১ সালের ১৪-১৬ই ফেব্রুয়ারি মতিঝিল ইডেন হোটেলে অনুষ্ঠেয় দলের কাউন্সিলকে সামনে রেখে তা এমনই চরমরূপ লাভ করে যে, আওয়ামী লীগের ভাঙ্গন নিশ্চিত বলে তখন অনেকেই মনে করেন।৭ পত্র-পত্রিকায় এই মর্মে শিরোনাম হয়।  দলের এ-রকম এক সন্ধিক্ষণে  বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার আবির্ভাব ঘটে আওয়ামী লীগের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে।৮ তখন দিল্লিতে তাঁর নির্বাসিত জীবন। বয়স মাত্র ৩৩ বছর। তাঁর অনুপস্থিতিতেই দলের সর্বমহল বা পক্ষ সর্বসম্মতিক্রমে তাঁকে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত করেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দীর্ঘ ৬ বছর নির্বাসিত জীবন যাপনে বাধ্য হয়ে অবশেষে ১৭ই মে ১৯৮১ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার প্রিয় স্বদেশে প্রত্যাবর্তন। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, মানুষের ‘ভোট  ও ভাতের’ অধিকার আদায় এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শুরু হয় তাঁর জীবনের এক দীর্ঘ সংগ্রাম। প্রধানত তাঁর নেতৃত্বেই এরশাদের দীর্ঘ  সেনাশাসন (১৯৮২-১৯৯০)-এর অবসান ঘটে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিও তাঁর আন্দোলনের কারণেই সেদিন সফলতা লাভ করে। ২১ বছর  ধরে বিরোধী দলে অবস্থান আর জেল-জুলুম-নির্যাতন ভোগ শেষে ১৯৯৬ সালের ১২ই জুনের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগের সরকার গঠন ও ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন তাঁরই নেতৃত্বের সাফল্য। মুখ্যত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের (২০০১-২০০৬) জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ভবিষ্যৎ নির্বাচনে তাদের পক্ষে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে গৃহীত বিশেষ পদক্ষেপ (সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অবসরগ্রহণের বয়স বৃদ্ধি) থেকে উদ্ভূত চরম সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ১/১১-এর সৃষ্টি। এরপর সেনানিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার সেনাশাসনকে দীর্ঘায়িত করার নীলনকশা নিয়ে তথাকথিত সংস্কার কর্মসূচির নামে বড় রাজনৈতিক দলে ভাঙ্গন সৃষ্টি, দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের দুই নেত্রীকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে দেয়া বা ‘মাইনাস টু থিওরি’ ইত্যাদি উদ্যোগ নিয়ে অগ্রসর হলে, শেখ হাসিনার দৃঢ় ও সাহসী অবস্থানের কারনে সে ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়ে যায়। ফলে ২০০৮ সালের শেষের দিকে জাতীয় নির্বাচন দিতে নেপথ্য সেনাশাসকরা বাধ্য হন। জাতি  নতুন করে দীর্ঘ সেনাশাসনের হাত থেকে রক্ষা পায়। ২০১৪ সালেও বিএনপি-জামায়াত জোট জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিহত করার নামে প্রকারান্তরে যখন সেনাশাসন কায়েমের পক্ষে কাজ করছিল, সে সময়ও শেখ হাসিনা অত্যন্ত দৃঢ়তা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে ঐ ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দিয়ে দেশে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে সক্ষম হন।

১৯৮১ সাল থেকে শুরু করে আন্দোলন-সংগ্রামের দীর্ঘ পথে শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারবরণ, একাধিকবার গৃহে অন্তরীণ থাকা, প্রায় এক বছর তাঁর শেরে বাংলানগরের নির্জন কক্ষে সাব-জেলে কাটানো, মিথ্যা মামলায় বিশেষ আদালতে বিচারের সম্মুখীন হওয়া, হত্যার উদ্দেশে জনসভা স্থলে বিধ্বংসী বোমা পুতে রাখা, জনসভা স্থলের উদ্দেশ্যে যাত্রাকালে গাড়ি বহরে শত-শত রাউন্ড গুলি বর্ষন ও বহু লোককে হতাহত করা (চট্টগ্রাম, ২৪শে জানুয়ারি ১৯৮৮), ২৪ বার তাঁর নিজের প্রাণনাশের উদ্দেশে আক্রমণের চেষ্টা ইত্যাদি তাঁকে অতিক্রম করতে হয়েছে। ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিন্যু’র তাঁর সমাবেশে প্রকাশ্য দিবালোকে গ্রেনেড হামলার প্রধান টার্গেট যে ছিলেন শেখ হাসিনা স্বয়ং, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনি অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে যান  বটে, তবে নারী নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতা-কর্মী ঐ ঘটনায় প্রাণ হারান। অনেকে চিরদিনের জন্য পঙ্গুত্ববরণ করেন। তিনি নিজেও আহত হন।

শেখ হাসিনার এ সংগ্রামে জাতির পিতার মতো একমাত্র হাতিয়ার ছিল সত্যের আদর্শ ও সততার শক্তি, লক্ষ্য অর্জনে সম্পূর্ণ নিবেদিত প্রাণ, জনগণের কল্যাণে শতভাগ অঙ্গীকার, তাঁর প্রতি জনগণের অগাধ বিশ্বাস ও মমত্ববোধ, সর্বোপরি দেশজুড়ে আওয়ামী লীগের মতো নিবেদিতপ্রাণ কর্মীনির্ভর শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠন। ১৯৮১ সাল থেকে ৩৫ বছর ধরে তিনি সভানেত্রী হিসেবে আওয়ামী লীগের সফল নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। কাউন্সিলরগণ প্রতিবারই সর্বসম্মতিক্রমে ঐ পদে তাঁকে নির্বাচিত করে আসছেন এবং ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে, ধরে নেয়া যায়। বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে শেখ হাসিনার প্রতি নেতা-কর্মী-কাউন্সিলরদের বিশেষ  স্নেহ, ভালোবাসা তো রয়েছেই। এর ওপর আরো যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, তাঁর নেতৃত্বের যোগ্যতা। শুধু দলের মধ্যেই নয়, ঐ গ-ি পেরিয়ে শেখ হাসিনা আজ  বিশ^নন্দিত নেত্রী। তবে তাঁর ভরসার প্রধান ও সর্বশেষ অবলম্বন আওয়ামী লীগ ও এর সাধারণ নেতা-কর্মীরাই। সংগঠনগতভাবে দেখলেও, আওয়ামী লীগের শক্তিভিতের মূল উৎস এর মাঠ পর্যায়ের সুবিশাল কর্মীবাহিনী। ৭৫-এর ১৫ই আগস্ট আপনজন বলতে প্রায় সবাইকে হারিয়ে আওয়ামী লীগই যেন আজ শেখ হাসিনার নিজ পরিবার,৯ যে পরিবারের প্রধান অভিভাবক বঙ্গবন্ধু স্বয়ং। দলের সাধারণ নেতা-কর্মীরাও শেখ হাসিনাকে অনুরূপভাবে বরণ করে নিয়েছেন। ১/১১-পরবর্তী ২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে শেখ হাসিনা সংগঠনের মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের ভূমিকার প্রশংসা করে বলেন,
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অনেক ঘটনা ঘটেছে। তৃণমূল নেতাদের দৃঢ়তার কারণে দলকে এ পর্যন্ত নিয়ে আসা গেছে, আপনারা আমাকে রক্ষা করেছেন’, আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে ‘কর্মীরাই হাল ধরে’।১০
উল্লেখ্য, আগরতলা রাষ্ট্রদ্রোহিতা মামলা থেকে ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে মুক্তিলাভের পর ১৯৭০ সালের ৪-৫ই জুন  মতিঝিল ইডেন হোটেলে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু তাঁর কারাবন্দি থাকাকালীন কতিপয় সিনিয়র নেতার আওয়ামী লীগকে ভাঙ্গার চেষ্টা এবং তখন দলের মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের ভূমিকার প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেছিলেন,
আমি যখন কারাগারে সেই সুযোগে নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান যুক্তফ্রণ্ট [পিডিএম] গঠনের নামে আওয়ামী লীগের মধ্যে ভাঙ্গন সৃষ্টি এবং আমাকে ডিসমিস করিয়া নতুন পাল্টা আওয়ামী লীগ গঠন করেন। কিন্তু তিনি জানিতেন না নেতা নেওয়া যায়, কর্মী নেওয়া যায় না, তাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক রক্তের।১১

ক্ষমতার বাইরে তো বটেই, এমনকি ক্ষমতায় থাকাকালেও আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত ও প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তির ষড়যন্ত্র, সন্ত্রাসী তৎপরতা ইত্যাদি মোকাবিলা করে সব সময় এগিয়ে যেতে হয়েছে।  যেমন সরকার গঠনের ৫১ দিনের মধ্যে ২০০৯ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি পিলখানার বিডিআর বিদ্রোহ, যাতে বেশ কিছু সংখ্যক সেনা অফিসার হত্যার শিকার হন, ২০১৩ সালের ৫-৬ই মে ঢাকার মতিঝিল শাপলা চত্বরে হেফাজাতে ইসলামের রাস্তা দখল করে অবস্থান গ্রহণ, ২০১২ ও ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল, ৫ই জানুয়ারি ২০১৪ অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিহত করা এবং ২০১৫ সালে নির্বাচনের এক বছর পূর্তিতে বিএনপি-জামায়াত জোটের দেশজুড়ে রাস্তা কেটে, রেল লাইনের স্লিপার উপড়ে ফেলে, গাছ কেটে রাস্তায় ফেলে অবরোধ সৃষ্টি, চলন্ত গাড়িতে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে নির্বিচারে যাত্রীদের হত্যা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হত্যা ইত্যাদি চরম সন্ত্রাসী ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি শেখ হাসিনার সরকারকে মোকাবিলা করতে হয়েছে। পাশাপাশি এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়েছে উন্নয়নের ‘ভিশন ২০২১’। এটিই হলো আওয়ামী লীগের পথ চলার ইতিহাস।

এবার সংক্ষেপে আওয়ামী লীগের ঐতিহ্য সম্বন্ধে কিছু কথা বলা যাক। ঐতিহ্য হচ্ছে সেসব বিষয় যা সমাজে যুগ-যুগ ধরে চলমান, মানুষ স্বেচ্ছায় ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেনে চলে, ধারণ করে। ঐতিহ্য সংস্কৃতিরই অংশ বিশেষ। আওয়ামী লীগ সৃষ্টি থেকেই বাংলা ও বাঙালির দল। এই দিন নিজেকে কখনো সর্ব পাকিস্তানভিত্তিক দল হিসেবে গড়ে তুলতে চায়নি। আওয়ামী লীগ বাঙালির ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, পোষাক-পরিচ্ছদ, খাদ্য, ব্যবহার্য, অর্থনীতি, লোকাচার ইত্যাদি নিয়ে গড়ে ওঠা এ-সব ঐতিহ্যের স্বার্থক প্রতিনিধিত্বকারী। আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির মূল বৈশিষ্ট্য সমন্বয়, সমতা ও সম্প্রীতি (অসাম্প্রদায়িকতা যার আদর্শিক রূপ)-কে আওয়ামী লীগের মতো আর কোনো দল এভাবে এ দেশে ধারণ করে কি-না, আমাদের জানা নেই।  ১লা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ আনন্দঘন পরিবেশে সমগ্র জাতি যাতে উদযাপন করার সুযোগ পায় সে লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ সরকারই (১৯৫৬-১৯৫৮) এ দিনটিকে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করে। আর শেখ হাসিনার সরকার এসে আরো এক ধাপ এগিয়ে চাকরিজীবীদের জন্য প্রচলন করেছে বাংলা নবর্ষের উৎসব ভাতা।

সংগঠনগতভাবে আওয়ামী লীগ নিজেই অনেক ঐতিহ্যের অধিকারী। যেমন ২০১৬ এ অনুষ্ঠেয় কাউন্সিলসহ দলটি ৬৭ বছরে মোট ২০টি নিয়মিত কাউন্সিল এবং আরো অন্তত ৪টি বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশন এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত করেছে অর্থাৎ গড়ে ৩ বছরে একটি।১২ বাংলাদেশে ডান-বাম নির্বিশেষে আর কোনো দল এভাবে প্রায় নিয়মিত কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত করতে সক্ষম হচ্ছে বলে মনে হয় না। আওয়ামী লীগের আর একটি ঐতিহ্য হচ্ছে, এর বিভিন্ন বডি বা কমিটির সভা কমবেশি নিয়মিত অনুষ্ঠিত হওয়া। দলের  নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রেও আওয়ামী লীগের ঐতিহ্য হলো, কাউন্সিল কর্তৃক সর্বসম্মতিক্রমে দলের সভাপতি/সভানেত্রী ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন।এ ব্যাপারে পূর্বে দুই শতাধিক সদস্য নিয়ে গঠিত সাবজেক্ট কমিটিতে বিশদ আলাপ-আলোচনা হয়। কাউন্সিলই সর্বসম্মতিক্রমে দলের সভাপতি/সভানেত্রীর ওপর কমিটির বাকি কর্মকর্তা ও সদস্যদের মনোনয়নের ক্ষমতা অর্পণ  করে। তবে সভাপতি/সভানেত্রী এককভাবে সেটি সম্পন্ন না করে দলের সাধারণ সম্পাদক ও “মুরব্বীদের” (প্রেসেডিয়াম সদস্য ও অন্যান্য) সঙ্গে পরামর্শ করে এরপর পূর্ণাঙ্গ কমিটি  ঘোষণা করে থাকেন। নেতৃত্ব নির্বাচনের এ প্রক্রিয়াকে Consensual Democracy হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। আওয়ামী লীগের অপর ঐতিহ্য বা বৈশিষ্ট্য  হচ্ছে, এটি সব সময় নির্বাচনমুখি ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতির অনুসারী। নির্বাচন বর্জন এর ইতিহাস নয়, বরং নির্বাচনে অংশগ্রহণই (সাফল্য যাই হোক না কেন) এর ইতিহাস-ঐতিহ্য। আওয়ামী লীগের ৬৭ বছরের ইতিহাসে এরশাদের ১৯৮৮ সালের প্রহসনের নির্বাচন এবং বিএনপি’র মধ্য ফেব্রুয়ারি (১৯৯৬)-এর দলবিহীন, ভোটারহীন তথাকথিত নির্বাচন এ দুটি ব্যতীত আওয়ামী লীগের নির্বাচন বর্জনের কোনো ইতিহাস নেই। আওয়ামী লীগের ঐতিহ্যে বা বৈশিষ্টের আর  একটি গুরুত্বপূর্ণ  দিক হলো, প্রতিষ্ঠানটি শুরু থেকেই পুরুষের পাশাপাশি নারীর সমান অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চয়তা বিধানের ব্যাপারে অঙ্গীকারাবদ্ধ থেকেছে। দলের সদস্য হওয়ার যোগ্যতার ক্ষেত্রে ১৯৫৫ সালেই গঠনতন্ত্রে ‘নারী-পুরুষ নির্বিশেষে’ এরূপ স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে মহিলাদের জন্য কাউন্সিলরদের শতকরা ১০ ভাগ আসন সংরক্ষিত রাখার বিধান করে গঠনতন্ত্রে সংশোধনী আনা হয়। বর্তমানে শেখ হাসিনার হাতে নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়নের বিষয়টি একটি পূর্ণমাত্রা বা রূপ লাভ করেছে, যা দেশ-বিদেশে বিপুলভাবে প্রশংসিত।

৬৭ বছরের প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগ নিজেই একটি ইতিহাস। ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামে এর যাত্রা শুরু (১৯৪৯)। ৪৮-৫২-র ভাষা-আন্দোলন ও ৫৪-র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের চরম ভরাডুবি ঘটলে পরিবর্তিত অবস্থায় ১৯৫৫ সালে রূপমহল সিনেমা হলের কাউন্সিলে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দিয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’, সংক্ষেপে আওয়ামী লীগ বা অসাম্প্রদায়িকীকরণের মাধ্যমে সবার জন্য দলের দ্বার উন্মুক্ত করা হয়। এরপর পুনরায় স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে ১৯৭২ সালের ৭-৮ই এপ্রিল অনুষ্ঠিত প্রথম কাউন্সিলে (কাকরাইল আওয়ামী লীগ অফিসের সম্মুখস্থ স্থান) দলের পুনঃনামকরণ  হয়, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এ ছাড়া দীর্ঘ এ সময়ে দলের ম্যানিফেস্টো, ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্র, কর্মসূচি, নীতি-নির্ধারণ, নেতৃত্ব নির্বাচন ইত্যাদি ক্ষেত্রেও পরিবর্তন-পরিবর্ধন-সংযোজনের ধারায় আওয়ামী লীগ আজকের এ পর্যায়ে পৌঁচেছে। এসব নিয়ে দেশ-বিদেশের ইতিহাসবেত্তা ও গবেষকদের উৎসাহের অন্ত নেই। বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়ে এর ওপর রচিত হচ্ছে উচ্চ ডিগ্রির অভিসন্দর্ভ বা গবেষণা কর্ম।

আওয়ামী লীগ এ দেশের একটি ব্যতিক্রমধর্মী রাজনৈতিক দল, যার তুলনা আওয়ামী লীগ নিজেই। জাতির স্বাধীনতা অর্জনে নেতৃত্বদানের পরও দীর্ঘ সময় ধরে দোর্দণ্ড প্রতাপে রাজনীতির অগ্রভাগে থেকে কোনো দলের এরূপ নেতৃত্বদানের উদাহরণ খুব বেশি পাওয়া যাবে না। তাহলে আওয়ামী লীগের এই অন্তর্নিহিত শক্তির উৎস কী? এক. তারুণ্য। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার দেড় বছর পূর্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ (৪ঠা জানুয়ারি ১৯৪৮), বর্তমান ছাত্রলীগ যার উত্তরাধিকার। আর তারুণ্য মানেই শক্তি, গতি ও সৃষ্টি। বঙ্গবন্ধুর একটি মন্তব্য ছিল, ‘ছাত্রলীগ এ দেশের গণসংগ্রামের জনক।’১৩ তারুণ্যকে দলের সঙ্গে যুক্ত রাখার ধারা বর্তমানেও আওয়ামী লীগে অক্ষুণœ রয়েছে। দুই. ধারণ ক্ষমতা (Absorbing Capacity)। আওয়ামী লীগের ধারন ক্ষমতা অফুরন্ত, যা দলের জন্য শক্তি সঞ্চয়ে খুবই সহায়ক। তিন. পরিবর্তনশীলতা বা পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে সহজে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম হওয়া (Adaptability)। চার. বাস্তববাদিতা (Realism/Real Politic Approach) অর্থাৎ যথাসময় যথাকর্মটি করা বা সঠিক কর্মসূচি উপস্থাপন, যেমন ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ৬-দফা, ২০০৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে শেখ হাসিনার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অঙ্গীকার। পাঁচ. অগ্রবর্তী চিন্তা বা কর্মসূচি, যেমন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৬৪ সালের কাউন্সিল অধিবেশনে আওয়ামী লীগ-এর যমুনা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের প্রস্তাব, ১৯৭০ সালের কাউন্সিলে মহকুমাগুলোকে জেলায় উন্নত করার প্রস্তাব; ২০০৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে শেখ হাসিনার পদ্মাসেতু ও চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে ট্যানেল নির্মাণের পরিকল্পনা ঘোষণা, শেখ হাসিনার ‘ভিশন ২০২১’ ডিজিটাল বাংলাদেশ ইত্যাদি।

পরিশেষে, আওয়ামী লীগ শুধু ক্ষমতা প্রত্যাশী একটি গতানুগতিক রাজনৈতিক দল নয়। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতির একটি বিশেষ ধারার প্রতিনিধিত্বকারীও। আর সেই ধারাই হচ্ছে বাংলাদেশের মূলধারা। এর সারকথা হচ্ছে, সমন্বয়, সমতা ও সম্প্রীতি। দেশের বৃহত্তম, দায়িত্বশীল ও ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আওয়ামী লীগ শুধু দেশ পরিচালনায়ই নেতৃত্ব দেয় না, একই সঙ্গে দেশবাসীর সম্মুখে তুলে ধরে পথ চলার অগ্রবর্তী চিন্তাও। আওয়ামী লীগ আজ যা ভাবে, এ দেশে অনেক দল তা কাল কিংবা কখনো ভাবতে পারে না।

তথ্যনির্দেশ
*  পূর্ব পাক আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশনে [বঙ্গবন্ধুর] সাংগঠনিক  রিপোর্ট, ৩রা জুলাই ১৯৫৩ (পুস্তিকা); আরো দ্রষ্টব্য,  ড. আবুল কাশেম (সংকলন ও সম্পাদনা), বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম ও আওয়ামী লীগ : ঐতিহাসিক দলিল, ঢাকা ২০০১, পৃ. ৫৮
*    উল্লেখ্য, বিশ্বে গড় আয়ু ৬৯ বছর।
*    ভাষা-আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা দ্রষ্টব্য, হারুন-অর-রশিদ, বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পুনর্পাঠ, ঢাকা ২০১৩, পৃ. ৩৯-৪৪
*    বিস্তারিত দ্রষ্টব্য, হারুন-অর-রশিদ, ‘আমাদের বাঁচার দাবী’ : ৬-দফা’র ৫০ বছর, বাংলা একাডেমি, ঢাকা ২০১৬, পৃ. ৩৫-৫৬
*    শেখ মুজিবুর রহমান, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের বার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে সাধারণ সম্পাদকের বার্ষিক রিপোর্ট, ১৯৫৫ (পুস্তিকা), পৃ. ৩২
*   দ্রষ্টব্য, গোলাম আকবর চৌধুরী, বাংলাদেশের রাজনীতি ও আওয়ামী লীগের ভূমিকা, ঢাকা ১৯৯৭, পৃ. ১৮-২৩
*    দ্রষ্টব্য, ‘আওয়ামী লীগের কোন্দলের চরম বহিঃপ্রকাশ : দ্বিধা বিভক্তির সম্ভাবনা স্পষ্ট’, আজাদ, ২রা ফেব্রুয়ারি ১৯৮১, পৃ. ১, ৮; ঐ, ৯ই ফেব্রুয়ারি ১৯৮১, পৃ. ১, ৭, ৮
*   বিস্তারিত দ্রষ্টব্য, হারুন-অর-রশিদ, মূলধারার রাজনীতি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ : কাউন্সিল ১৯৪৯-২০১৬, বাংলা একাডেমি (প্রকাশিতব্য), অধ্যায় চৌদ্দ।
*   ১৯৮৭ সালে ১-৩ জানুয়ারি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে আওয়ামী লীগ কাউন্সিলে দলের সভানেত্রী হিসেবে তাঁর প্রথম সরাসরি ভাষণে শেখ হাসিনা বলেন, “… আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করে ১৯৮১ সালের ১৭ই মে দেশে ফেরার পর বঙ্গবন্ধু প্রেমিক বাংগালী জাতি আমাকে সুগভীর আত্মীয়তায় একাত্ম করে নিয়েছে।” দ্রষ্টব্য, আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশনে সভানেত্রীর ভাষণ, ১৯৮৭ (পুস্তিকা)। তিনি একই ভাষণে বলেন, “… আপনাদের সুগভীর আত্মীয়তা আমাকেও পিতৃ-মাতৃ-ভাই-স্বজনহীন এই স্বদেশে শুধু বেঁচে থাকার শক্তিই দেয়নি সংগ্রামের সাথে একাত্ম হওয়ার সাহসও দিয়েছে। আমি সব হারিয়ে আপনাদের মাঝে ফিরে এসেছি।”
*    দ্রষ্টব্য, সংবাদ, ২৫শে জুলাই ২০০৯, পৃ. ১, ২; ইত্তেফাক, ২৫শে জুলাই ২০০৯, পৃ. ১, ২
*    দ্রষ্টব্য, ‘কাউন্সিলরদের প্রতি আওয়ামী লীগ প্রধানের উদাত্ত আহ্বান,’ ইত্তেফাক, ৫ই জুন ১৯৭০, পৃ. ১, ১০
*    বিস্তারিত দ্রষ্টব্য, হারুন-অর-রশিদ, মূলধারার রাজনীতি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ : কাউন্সিল ১৯৪৯-২০১৬, বাংলা একাডেমি (প্রকাশিতব্য)।
*   দ্রষ্টব্য, ‘কাউন্সিলরদের প্রতি আওয়ামী লীগ প্রধানের উদাত্ত আহ্বান’, ইত্তেফাক, ৫ই জুন ১৯৭০, পৃ. ১, ১০প্রবন্ধটি লেখকের বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিতব্য মূলধারার রাজনীতির বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ : কাউন্সিল ১৯৪৯-১৯১৬ শীর্ষক গ্রন্থের ওপর ভিত্তি করে রচিত। ব্যবহৃত তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষিত।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top