সকল মেনু

অর্থনৈতিক উন্নয়নে চীন বড় অংশীদার : মুন্সী ফায়েজ আহমেদ

xi-jinping_38414হটনিউজ২৪বিডি.কম : দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিক মুন্সী ফায়েজ আহমেদ ২০০৭ থেকে ২০১২ পর্যন্ত গণপ্রজাতন্ত্রী চীনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। বর্তমানে তিনি ‘বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ’ (ইওওঝঝ)-এর চেয়ারম্যান। চীনা ভাষায় তার দক্ষতা আছে। কর্মজীবনে তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক ও সিঙ্গাপুরে হাইকমিশনার পদে, নিউইয়র্কে বাংলাদেশের জাতিসংঘ মিশন, লন্ডন, কাতার ও হংকংয়ে কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করেছেন এবং বহু আন্তর্জাতিক-আঞ্চলিক সম্মেলনে দেশের প্রতিনিধি দলে কাজ করেছেন

প্রশ্ন : চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের এবারের সফরের তাৎপর্য কীভাবে দেখছেন?
উত্তর : চীনের মতো বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তিধর দেশের উচ্চ পর্যায়ের যে কোনো প্রতিনিধি দলের সফরই গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে প্রেসিডেন্টের সফর অবশ্যই বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। প্রেসিডেন্ট একই সঙ্গে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান এবং সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশনেরও চেয়ারম্যান। চীনের শীর্ষ পর্যায়ের একজন নেতার বাংলাদেশ সফর মাঝে অনেক দিন হয়নি। শি জিনপিং ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালে ২০১০ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন; সেবার চার দেশ সফর শুরু করেছিলেন ঢাকায় এসে। আবার এখন আসছেন প্রেসিডেন্ট হয়ে। বোঝা যায়, বাংলাদেশের প্রতি তার বিশেষ মমত্ববোধ রয়েছে। তিনি বাংলাদেশকে ইতিবাচক অর্থেই গুরুত্ব দিয়ে দেখেন। এ কারণে তার সফরের একটা পৃথক সিম্বলিক (প্রতীকী) তাৎপর্যও রয়েছে। সবকিছু বিচার করে বলা যায় এ সফর থেকে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে।

বলা দরকার, চীনারা কর্মমনস্ক জাতি, তারা খুব কাজ বোঝে। তাদের যে কোনো প্রতিনিধি দলের সফরই হয় বিশেষ কোনো কাজকে সামনে রেখে। বাস্তবিক অর্থে কাজই তাদের প্রধান অগ্রাধিকার। চীনের প্রেসিডেন্টের সফর নিয়ে দুই বছর ধরে আলোচনা হয়েছে, প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ সফর থেকে বাস্তব অর্জন কী হবে তা নির্ধারণ করার পরই এখন চীনের প্রেসিডেন্ট আসছেন। নিশ্চিতভাবেই তিনি উন্নয়ন সহযোগিতা, বিনিয়োগ, বাণিজ্য সব মিলিয়ে নতুন কিছুর বার্তা নিয়ে আসছেন, যা বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই শুভ সংবাদ হবে।

প্রশ্ন : চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি বেশ বড় আকারের। চীনা প্রেসিডেন্টের সফরের মাধ্যমে এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক অগ্রগতি আশা করা যায়?
উত্তর : চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতিকে বড় করে দেখার কিছু নেই। বাংলাদেশসহ চীন এখন বিশ্বের ১৩০টি দেশের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদার। বাংলাদেশের সঙ্গেও তাদের বাণিজ্য রয়েছে। বাংলাদেশ চীন থেকে বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল, কলকারখানার মেশিনপত্র, যন্ত্রাংশ, বস্ত্র, ভোগ্যপণ্য অপেক্ষাকৃত কম দামে নিয়ে আসছে। সেই কাঁচামাল থেকে পণ্য উৎপাদনের পর সেই পণ্য কিন্তু এখন চীনেও রফতানি করা হচ্ছে। ফলে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি থেকে ক্ষতি হচ্ছে, সে ধরনের ধারণা সঠিক নয়।

একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ মূলত রফতানি করে গার্মেন্ট পণ্য। আর চীন হচ্ছে বিশ্বের বৃহত্তম গার্মেন্ট পণ্য রফতানিকারক দেশ। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম। এখন বাংলাদেশ থেকে চীনে তৈরি পোশাক রফতানি করা হবে, সেটা কিন্তু বিস্ময়কর মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশ চীনেও তৈরি পোশাক রফতানি করছে। বর্তমানে চীনে বছরে যে প্রায় এক থেকে দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য রফতানি করা হয়, তার ৬০ শতাংশই তৈরি পোশাক। এখন চীনে রফতানি বাড়াতে হলে তারা আর কী কী ধরনের পণ্য আমদানি করে, সে বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। সে অনুযায়ী বাংলাদেশের এক্সপোর্ট বাস্কেটটা বাড়াতে হবে। তাহলে রফতানিও আরও বাড়বে। এমনিতেই তো চীন বাংলাদেশি পণ্যের ক্ষেত্রে বেশ কিছু সুবিধা দিচ্ছে। প্রায় পাঁচ হাজার ধরনের পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশের সুযোগ দিচ্ছে, যেটা মোট রফতানির ৯৭ শতাংশ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়। এর বাইরে বাংলাদেশ ১৭টি বিশেষ পণ্যের ক্ষেত্রে কোটামুক্ত প্রবেশের দাবি জানাচ্ছে। চীনের প্রেসিডেন্টের সফরেও এ বিষয়টি উঠবে এবং ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাবে বলেই আশা করা হচ্ছে।

প্রশ্ন : এ সফরে মেগা প্রকল্পে চীনের আরও বেশি সহায়তা পাওয়ার আশা করা হচ্ছে।

উত্তর : অবশ্যই। চীন তো বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের বিভিন্ন বড় প্রকল্পে আগে থেকেই সহায়তা দিয়ে আসছে। চীনের প্রেসিডেন্টের সফরকে কেন্দ্র করে কয়েকটি প্রকল্পে সহায়তার জন্য সমঝোতা স্মারক, চুক্তি সই হবে, এমন আলাপ-আলোচনাও তো চলছে। সেসব চুক্তি অবশ্যই সফরের সময় স্বাক্ষর হবে বলে আশা করা যায়।

একটা বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে যে, বর্তমান বিশ্বে চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রাখতে চায় নাথ এমন কোনো দেশ নেই। বিশেষ করে অবকাঠামো উন্নয়নে চীন এখন শীর্ষে। বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, চীন বিশ্বে একমাত্র দেশ যারা বিশ্বে অবকাঠামো রফতানি করে। কোনো দেশ প্রযুক্তি রফতানি করে, কোনো দেশ অস্ত্র রফতানি করে আর চীন রফতানি করে অবকাঠামো।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলোও অবকাঠামো উন্নয়নে চীনের প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নিচ্ছে। অবকাঠামো উন্নয়নের দিক থেকে বাংলাদেশ কিন্তু অনেক পিছিয়ে। এখনও অনেক বড় অবকাঠামো তৈরির প্রয়োজন রয়েছে। এ ক্ষেত্রে চীনের সহযোগিতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অবকাঠামো উন্নয়নে চীন যেমন দক্ষ, তেমনি আর্থিক সহযোগিতাও দেয়। ফলে এ ক্ষেত্রে চীনের সহযোগিতা যত বেশি পাওয়া যায়, ততই দেশের জন্য ভালো। চীন এক অর্থে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মতোই। ফলে বিশ্ব যেখানে অবকাঠামো উন্নয়নে চীনকে প্রাধান্য দিচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশ আরও বাড়তি সুবিধা তো আশা করতেই পারে।

প্রশ্ন : কারও কারও মতে, ভারত-চীন সম্পর্কে কিছুটা শীতলতা আছে। এ কারণে চীনের প্রেসিডেন্টের সফর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে কোনো প্রভাব ফেলতে পারে কি?

উত্তর : ভারত-চীন সম্পর্কে কোনো শীতলতা নেইথ এ ধরনের ধারণা একেবারেই ভুল। বরং ভারত ও চীনের মধ্যে দৃঢ় উন্নয়ন ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। দুই দেশের মধ্যে বার্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ গত ১৫ বছরে ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের আদান-প্রদানও খুবই উল্লেখযোগ্য। ভারতের প্রচুর উন্নয়ন কাজে চীনা প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। ভারতের বড় বড় ব্যবসায়ী চীনে বাণিজ্য করছেন। চীনের প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর করেছেন। প্রেসিডেন্টও বাংলাদেশ থেকেই গোয়ায় ব্রিকস সম্মেলনে যাচ্ছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও চীন সফরে উষ্ণ আতিথেয়তা পেয়েছেন। ভারত-চীন সম্পর্ক অত্যন্ত ভালো, সন্দেহ নেই।

আসলে ভারত-চীনের মধ্যে সীমান্ত নিয়ে একটা সমস্যা থাকলেও সেটা অর্থনীতি, বাণিজ্য কিংবা অন্য কোনো সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলে না। ভারত এবং চীন দুই দেশই অত্যন্ত দক্ষতা ও দূরদৃষ্টি নিয়ে সম্পর্কোন্নয়ন করেছে, যেখানে তারা সীমান্ত সমস্যাকে উহ্য রেখেছে। সে কারণে ১৯৬২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ভারত-চীন সীমান্তে বড় ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। বরং সীমান্ত সমস্যা সমাধানের জন্য দুই দেশের যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ কাজ করছে। এ সমস্যার সমাধান নিয়মতান্ত্রিকভাবে হবে বলেই আশা করা যায়।

অতএব, চীনের প্রেসিডেন্টের সফরে ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কে কোনো প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা নেই। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের গুরুত্ব এবং চীনের সঙ্গে সম্পর্কের তাৎপর্য যার যার অবস্থানে থাকবে।

প্রশ্ন : এ সফরকে ঘিরে আপনার আরও বিশেষ কোনো মূল্যায়ন?
উত্তর : চীনে বেশ কিছু সময় দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, চীন সবার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চায় এবং কারও সঙ্গেই সস্পর্কের অবনতি চায় না। তাদের মূল লক্ষ্য উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে আরও কীভাবে এগিয়ে নেওয়া যায়। চীনের প্রেসিডেন্টের সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক নতুন স্তরে পৌঁছে যাক এবং অবাকাঠামো উন্নয়নসহ অর্থনৈতিক উন্নয়নে চীন আরও বড় অংশীদার হোক, এটাই প্রত্যাশা থাকবে। সৌজন্যে : সমকাল

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top