সকল মেনু

কালের যাত্রায় হুমায়ূন আহমেদ

Humayun-Ahmed20130721010828হটনিউজটোয়েন্টিফোরবিডি.কম:প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হ‍ুমায়ূন আহমেদ কালের যাত্রায় ভেলা ভাসিয়েছেন হ‍ুমায়ূন আহমেদ, এক বছর আগে। গত বছর ঊনিশে জুলাই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন তিনি। অর্থাৎ হ‍ুমায়ূন-সময় থেকে একটি বছর দূরে চলে এলাম আমরা। তাঁর বিরাট সাহিত্য সম্ভার আজ সত্যিই সময়ের দহনের মুখোমুখি। নির্মম সময় চায়, সবকিছু মুছে দিতে।

যে একশ’ বছর মানুষের বোধে উজ্জ্বল থাকে, দু’শ’ বছরে এসে সে অনেকখানি ফিকে হয়ে যায়। সবটাই নির্ভর করে, কাকে মানুষ প্রয়োজনীয় মনে করে নিজেদের বিকাশের জন্য। যে সাহিত্য মানুষের জীবন ও জীবন সংগ্রামকে ধারণ করে, তা টিকে যায় বহু কাল। তাই স্বভাবত: প্রশ্ন জাগে, হ‍ুমায়ূন আহমেদ আর কত কাল পাঠকের হয়ে থাকবেন?

১) ভাল মানুষ হওয়াটা, যে কোনো বড় অর্জনের পূর্বশর্ত। কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের লেখা ‘স্মৃতিবিলাপ’ বলে দেয়, হ‍ুমায়ূন আহমেদ মানুষ হিসাবে কতটা চমৎকার ছিলেন। তাঁর বাড়ির দরজা ছিল সবার জন্য উন্মুক্ত।

হ‍ুমায়ূন ছিলেন বিনয়ী, বন্ধুবৎসল, বিজ্ঞানমনস্ক একজন আধুনিক বাঙালি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ধর্মনিরপেক্ষতা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা – এগুলো ছিল তাঁর যাপিত জীবনের অনুষঙ্গ। এরকম একজন মানুষের পক্ষেই তো সম্ভব মানুষ এবং তার জীবনকে সাহিত্যের আয়নায় প্রতিফলিত করা।

২) ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির জীবনের সব চেয়ে বড় ঘটনা। এই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে হ‍ুমায়ূনের আছে ৮টি উপন্যাস, ২টি চলচ্চিত্র এবং অজস্র নাটক। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এত ব্যাপক কাজ আর কোনো বাঙালি করেন নি।

আজ থেকে শতবর্ষ পরে কেউ যদি বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে চায়, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে চায়, তাকে অবশ্যই হ‍ুমায়ূন আহমেদ পড়তে হবে। এটা অবশ্যম্ভাবী। হ‍ুমায়ূন আহমেদ তাঁর জোছনা ও জননীর গল্প, আগুনের পরশমনি, শ্যামল ছায়া, সূর্যের দিন, ১৯৭১, সৌরভ, অনিল বাগচীর একদিন, নির্বাসন প্রভৃতির মাধ্যমে অমর হয়ে থাকবেন। নন্দিত কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনও এমনটাই মনে করেন।

৩) নিজের উপন্যাস থেকে হ‍ুমায়ূন বানালেন মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র। বাঙালি কি করে ভুলে যাবে ‘আগুনের পরশমনি’ ও ‘শ্যামলছায়া’ চলচ্চিত্র দু’টির কথা ? ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে এই চলচ্চিত্র দু’টিকে বাঙালির মনে রাখতে হবে বহুকাল, পাশাপাশি মনে রাখতে হবে এর নির্মাতা হ‍ুমায়ূন আহমেদকে।

৪) সাহিত্য প্রয়োজন মধ্যবিত্তের। উচ্চবিত্তের না, নিম্নবিত্তেরও না। উচ্চবিত্তের ও নিম্নবিত্তের চাওয়া-পাওয়া অন্যরকম। সাহিত্য তা অনেক সময়ই মেটায় না। সারা পৃথিবীতে তাই মধ্যবিত্তই সাহিত্য পাঠ করে এবং বাঁচিয়ে রাখে। হ‍ুমায়ূন আহমেদ কী করলেন, তিনি সাহিত্যে রচনা করলেন মধ্যবিত্তের সূক্ষ্ম জীবন ও জীবনবোধ।

হ‍ুমায়ূন আহমেদের পঁচানব্বই ভাগ লেখাতে স্থান পেল মধ্যবিত্তের জীবন ও জীবনের টানাপড়েন। আরো একটা ব্যাপার লক্ষ্য করল পাঠকরা, তাঁর নব্বই ভাগ লেখাতে মূল চরিত্র হিসেবে উঠে এলো বাবা, মা, ভাই, বোন, পাশের বাড়ির মেয়েটি কিংবা ছেলেটি, মহল্লার বেকার কোনো যুবক। সবক’টি চরিত্র অতি চেনা, অতি প্রিয়। এদের জীবনের প্রতিদিনকার ঘটনা-বিন্যাস এত জীবন্ত করতে কে পেরেছে অতীতে?

উপন্যাসে বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথের প্রচলিত নায়ক-নায়িকার গণ্ডি থেকে পাঠককে বের করে নিয়ে আসেন হ‍ুমায়ূন। যে কোনো চরিত্রই নিজের জীবনের নায়ক। তাই নয় কি? পাঠক নিজেদের খুঁজে পান হ‍ুমায়ূনের সৃষ্ট চরিত্রগুলোতে।

এভাবে ধীরে ধীরে বাঁধা পড়ে যায় পাঠকরা হুমায়ূনের লেখায়। বাড়তে থাকে তাদের সংখ্যা। ভাইয়ের হাতে বোন তুলে দেয় বই, বোনের হাতে ভাই। এক সময় মধ্যবিত্তের মধ্যমণি হয়ে ওঠেন হ‍ুমায়ূন।

জীবনবোধের লেখা সাধারণত জনপ্রিয় হয় না, তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখাও যেভাবে জনপ্রিয় হয় নি। কিন্তু হ‍ুমায়ূন আহমেদের ফেরা, অচিনপুর, শংখনীল কারাগার, নন্দিত নরকে, প্রিয়তমেষু, জনম জনম, মধ্যাহ্ন, মাতাল হাওয়া, জোছনা ও জননীর গল্প, অন্ধকারের গান ইত্যাদি বইগুলো যেমন জীবন ঘনিষ্ঠ, তেমনি জনপ্রিয়। এগুলো লেখককে নিঃসন্দেহে বাঁচিয়ে রাখবে।

৫) ভাষা সময়কে ধারণ করে। প্রতি তিরিশ বছরে এই ভাষা বদলে যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাধু ভাষা দিয়ে শুরু করেন, শেষের কবিতার ভাষা নির্মাণে আমরা অন্য রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে পাই। কবিতার ভাষা নির্মাণেও আমরা বদলাতে দেখি রবীন্দ্রনাথকে পুনশ্চ’র কবিতায়। বাংলাভাষার অনেক শব্দ রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন নতুন বানানে।

হ‍ুমায়ূন আহমেদের হাতে এই ভাষা পেয়েছে আরেক আধুনিক রূপ। সহজ-সরল-চলতি এক রূপ। একবার পড়তে শুরু করলে আর ছাড়তে পারে না পাঠক। অথচ এ গদ্য জীবনের গদ্য, মানুষের গদ্য । এমন কি গল্পের প্রয়োজনে উপন্যাসের কাঠামোও ভেঙে ফেললেন হ‍ুমায়ূন তাঁর জোছনা ও জননীর গল্প এবং মাতাল হাওয়া উপন্যাসে।

৬) কাহলিল জিবরান বলেছেন, যে লেখা তথ্য ও তত্ত্বমূলক তা গতিহারা হয়, যে লেখায় জীবনবোধ থাকে কিন্তু তত্ত্ব থাকে কম, তা হয় সর্বগামী। হ‍ুমায়ূন আহমেদের লেখা ঠিক এই ধাঁচের। পড়লে সহজেই মন ভাল হয়ে যায়। হিউমার, স্যাটায়ার রচনায় হ‍ুমায়ূনের লেখা বিশ্বমানের। তাঁর লেখা মননে ও মেধায় তৃপ্তি দেয়, স্নিগ্ধতা দেয়।

পাঠকরা একা একা কাঁদে, আবার একা একা হেসে ওঠে। হ‍ুমায়ূনের লেখা এতটাই শক্তিশালী যে, মাত্র দু’লাইন লিখে তিনি মানুষকে কাঁদাতে পারতেন, এক লাইন লিখে হাসাতে পারতেন। এমন শক্তিমত্তা বাংলা সাহিত্যে আর কোথায়?

৭) ছোটগল্পে হ‍ুমায়ূন ছিলেন বিশ্বসেরাদের একজন। তাঁর ছোটগল্পের সংখ্যা শতাধিক। হ‍ুমায়ূন আহমেদের গল্প সংকলন ‘গল্প পঞ্চাশৎ’ সংগ্রহে রাখার মত একটি অসাধারণ বই।

সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক মনে করেন, বিশ্বের বিশটি ছোটগল্পের একটি লিস্ট করলে সেখানে হ‍ুমায়ূন আহমেদের ছোট গল্প স্হান পাবে। কলকাতার রমাপদ চৌধুরীও এমনটাই ভাবেন।

৮) কল্পবিজ্ঞান বাংলা সাহিত্যের নতুন ধারা। হ‍ুমায়ূন আহমেদের ‘তোমাদের জন্য ভালবাসা’ বাংলা সাহিত্যের প্রথম সফল কল্পবিজ্ঞান। মোহম্মদ জাফর ইকবালসহ অনেকে এখন সাহিত্যের এই ধারাটি সমৃদ্ধ করে চলেছেন। কল্পবিজ্ঞান বাংলা সাহিত্যে যতদিন চর্চা হবে, হ‍ুমায়ূন আহমেদের নামটি কি আমরা এড়াতে পারবো?

৯) সিদ্ধার্থ (পরে যিনি গৌতম বুদ্ধ) চরিত্রটি হাজার বছর ধরে আমাদের আলোড়িত করে আসছে। এই মানুষটি জীবনকে উপলব্ধি করার জন্য প্রাসাদের ভোগের জীবনকে ত্যাগ করে পৃথিবীর পথে মানুষের মুক্তির পথ খুঁজেছেন। এ রকম একটি চরিত্র হ‍ুমায়ূন আহমেদ গড়েছেন হিমু নামে। সে সংসার বিমুখ, মানুষের উপকার করে বেড়ায়, যার নিজের কোনো চাহিদা নেই। খালি পায়ে হাঁটে। পৃথিবীর যে কোন মহাপুরুষ যেমনটা করতেন। এভাবে হ‍ুমায়ূন আধুনিক তরুণদের সামনে এক মূর্তি গড়ে দিলেন। আদর্শের মূর্তি। হিমু চরিত্রটি সাহিত্যে এক অভিনব সংযোজন। আমার বিশ্বাস, হিমু বাংলা সাহিত্যে স্থায়িত্ব পাবে।

১০) তরুণদের ভাল কাজে প্রভাবিত করতে পারা একটি বড় কাজ। হ‍ুমায়ূন আহমেদ এটি পেরেছেন। বাংলাদেশে আজ হাজার হাজার তরুণ লেখালেখির পোকা মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের অনেকে শুরু করেছে নিজেদের প্রথম লেখাটি। হুমায়ূন আহমেদ এসব তরুণদের সামনে আইডল। হ‍ুমায়ূনের স্বপ্নের উত্তরাধিকার এরা। এ কি এক চমৎকার বেঁচে থাকা নয়?

সাহিত্যের ক্লাসিক কি ? যে সাহিত্যকে সর্বোৎকৃষ্ট হিসাবে সবাই মেনে নেয়, সেটাই ক্লাসিক। আগে সাহিত্যের স্বীকৃতি আসতো শাসকদের থেকে। এখনো তাই। এ কারণে সম্রাজ্যবাদের রক্ষকরা লেভ তলস্তয়, আন্তন চেখভ, মাক্সিম গোর্কিকে নোবেল পুরস্কারের যোগ্য ভাবেনি। অথচ নোবেল পেয়েছেন বারিস পাস্তারনাক, সমাজতন্ত্রের সমালোচনার জন্য। কী হাস্যকর !

আনন্দের কথা, সাধারণ মানুষ এখন সাহিত্য কিংবা ক্লাসিক নির্বাচনে বড় ভূমিকা রাখছে। তারাই এখন নির্ধারণ করে, কোন বইটি তাদের প্রয়োজন। লেখকের প্রিয় বইটি তারা কিনে নেয় এবং সংগ্রহে রাখে।

সেই জায়গা থেকে আমি বলতে চাই, হ‍ুমায়ূন-সাহিত্যের অনেকখানি অংশই উৎকৃষ্ট হিসাবে পাঠকের মাঝে অনেক দিন বেঁচে থাকবে। আগামীর রোদ্দুর হয়ে হ‍ুমায়ূন আহমেদ বহুকাল মানুষের সামনে বাতিঘরের মত জ্বলবেন, এটা নিশ্চিত।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top