সকল মেনু

রাতের অন্ধকারে আসছে ভারতের গরু, রাজস্ব হারাচ্ছে বাংলাদেশ

 
রাতের অন্ধকারে আসছে ভারতের গরু, রাজস্ব হারাচ্ছে বাংলাদেশ
বিট মালিকদের দ্বন্দ্বের কারণে নওগাঁর সাপাহারের খঞ্জনপুর করিডোরটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে থাকায় সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। করিডোরটি বন্ধ থাকার সুযোগে সাপাহার সীমান্ত এলাকা দিয়ে রাতের অন্ধকারে আনা হচ্ছে ভারতীয় গরু-মহিষ। এদিকে অবৈধ প্রতি জোড়া গবাদিপশু থেকে সংশ্লিষ্টরা প্রায় দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা তুললে নিয়ম অনুসারে এক হাজার টাকা সরকারি খাতায় জমা করে বাঁকি টাকা পকেটস্থ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
সরজমিনে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকারি খাতায় মাত্র কয়েক জোড়া দেখানো হয় তার চেয়ে অনেক বেশি গবাদিপশু আনা হয় ভারত থেকে।
খঞ্জনপুর করিডোরের পরিচালক গোপাল কুমার মন্ডল জানান, সাপাহারের খঞ্জনপুর করিডোরটি চালু করতে বিভিন্ন কর্মকর্তাদের কাছে ধর্না দিয়ে ৫০ লাখ টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। সীমান্ত এলাকার কয়েকটি বিট মালিকদের দ্বন্দ্বের কারণে করিডোরটি দীর্ঘ এক বছর এক মাস বন্ধ আছে। এতে খঞ্জনপুর করিডোর দিয়ে ভারতীয় সীমানা দিয়ে গরু আনা সম্ভব হয়নি। এ কারণে সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে।
তবে সম্প্রতি করিডোরটি নবায়ন করা হয়েছে। ঈদের পরে সরকারের নির্দেশ পেলে করিডোরের মাধ্যমে গবাদিপশু আনা শুরু হবে। জেলায় কয়েকটি সীমান্ত এলাকার মধ্যে শুধু মাত্র সাপাহার উপজেলার হাঁপানিয়া সীমান্ত দিয়ে গত ২৯ আগস্ট থেকে গরু আনা শুরু হচ্ছে। প্রথম দিনে মাত্র ৫৪টি, ৩১ আগস্ট ৭১টি, ১ সেপ্টেম্বর ৫টি, ২ সেপ্টেম্বর ১৭টি, ৩ সেপ্টেম্বর ২৪টি, ৪ সেপ্টেম্বর ১৭টি, ৫ সেপ্টেম্বর ৮টি মাত্র গরু আনা হয়।
পরিচালক গোপাল কুমার মন্ডল আরো জানান, রাত ১২ টা থেকে ভোর রাতের মধ্যে এসব গবাদিপশু ভারত থেকে নিয়ে আসা হয়ে থাকে। জোড়া প্রতি সরকারি খাতায় এক হাজার টাকা জমা দিতে হলেও এগারো’শ’ টাকার মতো খরচ হয়ে থাকে। এ কারণেই কিছু টাকা বেশি নেয়া হয়ে থাকে।
তিনি আরো বলেন, করিডোরের সঙ্গে ৩৪ জন বেকার যুবক জড়িত। তাদের সংসারের আয়ের উৎস বলতে করিডোর ছাড়া অন্য কিছু উৎস নেই। করিডোর থেকে লাভের অংশ দিয়েই এই ৩৪ জনের পরিবার খরচ মেটায়।
অপর প্রশ্নে তিনি আরো বলেন, স্বচ্ছতার সঙ্গে গরু-মহিষ ভারত থেকে নিয়ে এসে রাজস্ব দেয়া হয়ে থাকে। সীমান্তে নিয়োজিত বিজিবি’র কর্মকর্তারা এসবের সঠিক হিসেব রাখেন।
জানা গেছে, জেলার সাথে ভারতীয় সীমান্ত এলাকা সংলগ্ন পোরশা, সাপাহার, পত্নীতলা ও ধামইরহাট উপজেলার ১২৭ কিলোমিটার সীমানা। বাংলাদেশি সীমান্তে জিরো পয়েন্ট অধিকাংশ এলাকায় বিজিবি সদস্যদের যাওয়ার কোন রাস্তা নেই। বেশি ভাগ বিজিবি ক্যাম্প সীমান্ত এলাকা থেকে প্রায় দেড়/দুই কিলোমিটার দূরে। সার্বক্ষণিক টহল দিলেও রাস্তার অভাবে বিজিবি সদস্যদের সীমান্ত এলাকায় পাহারা দিতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। রাতে বাংলাদেশি সীমান্ত এলাকায় কোন আলোর ব্যবস্থা না থাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা আরো ভয়াবহ হয়ে উঠে।
সীমান্ত এলাকায় কোন দুর্ঘটনা ঘটলে বা চোরাকারবারির আসা যাওয়ার সংবাদ পেলেও ঘটনাস্থলে দ্রুত যাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না।
এ ছাড়াও এই সীমান্ত এলাকায় নীতপুর থেকে হাঁপানিয়ার অনেক অংশে ভারতীয় কাঁটা তারের বেড়া নেই। এদিকে সীমান্ত এলাকায় রয়েছে বেশ কয়েকটি নদী- নালা। এই নদী-নালার মধ্যে নেই কোন কাঁটা তার। কাঁটা তারের বেড়া না থাকার সুযোগে বাংলাদেশি গরু ব্যবসায়ীরা চোরাকারবারিদের দিয়ে অবৈধ ভাবে ভারত থেকে গবাদিপশু নিয়ে আসেন। গরু চোরাকারবারিরা রাতের অন্ধকারে তারকাঁটা কেটে অবৈধ ভাবে ভারতে যায়। সারা রাত কেনাকাটা শেষে ভোর রাতে গরু নিয়ে ফিরে আসে। এক জোড়া গরু বা মহিষ ভারত থেকে নিয়ে এলে একজন চোরাকারবারি পেয়ে থাকে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা।
পবিত্র ঈদ-উল-আযহায় ধর্মপ্রাণ মুসল্লি প্রায় প্রতিটি পরিবার সামর্থ্য অনুযায়ী গবাদিপশু কোরবানি দিয়ে থাকেন। এ কারণে সারা বছরের তুলনায় ঈদ-উল-আযহায় গবাদিপশুর চাহিদা ও দাম বেড়ে যায়। এ কারণে সারা বছর ভারত থেকে গরু-মহিষ নিয়ে আসা হলেও ঈদ-উল-আযহায় এর পরিমাণ কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়। অবৈধভাবে গরু-মহিষ নিয়ে আসতে চোরাকারবারি মারাও যায়।
সর্বশেষ চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি সাপাহার উপজেলার আদাতলা সীমান্ত এলাকায় দিয়ে ভারত থেকে অবৈধ ভাবে গরু আনতে গিয়ে ভারতের অভ্যন্তরে বিএসএফের গুলিতে মারা যায় উপজেলার দক্ষিণ পাতাড়ি গ্রামের তোহরাব আলীর ছেলে জয়নাল আবেদিন (২৮) নামে এক বাংলাদেশি গরু চোরাকারবারি।
বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি)-১৪ পত্নীতলার অধিনায়ক লে. কর্নেল আলী রেজা জানান, জয়নাল আবেদিনের মৃত্যুর পর বিজিবি’র কড়া সর্তকতার ও সীমান্ত এলাকায় জনসচেতনতা প্রচার করা হয়েছে যাতে কেউ ভারতে অবৈধ ভাবে গরুর ব্যবসায় করতে না যান। আর এ কারণে ওই ঘটনার পর থেকে আর কোন বাংলাদেশি গরু ব্যবসায়ী বা চোরাকারবারি নওগাঁর সীমান্তে বিএসএফ’র গুলিতে মারা যাননি।
তিনি আরো জানান, সাময়িক নির্দেশ রয়েছে ভারতের কোন গরু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে বাংলাদেশে গরু ব্যবসায়ীরা ভারতের গরু-মহিষ আনতে চাইলে জিরো পয়েন্টে থেকে নিয়ে আসতে পারবে। তবে কোন ক্রমেই বাংলাদেশি গরু ব্যবসায়ীদের জিরো পয়েন্ট অতিক্রম না করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে গরু-মহিষ নিয়ে আসার পর এখন আর কোন বাংলাদেশি সীমান্তের জিরো পয়েন্ট অতিক্রম করেন না বলে লে. কর্নেল আলী রেজা জানান।
অপর এক প্রশ্নে তিনি আরো বলেন, সীমান্ত এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় সমস্যার সৃষ্টি হলেও বিজিবি’র সদস্যরা সতর্ক রয়েছেন। তবে সব সময় সীমান্ত এলাকায় চোরাকারবারিদের নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তারপরও রাতের অন্ধকারে অবৈধ ভাবে নিয়ে আসা অনেক গরু-মহিষ জব্দ করা হয়ে থাকে। সরকারকে রাজস্ব না দিয়ে কেউ যেন চোরা পথে কোন গরু-মহিষ নিয়ে এসে কেনা-বেচা করাতে না পারে সে দিকে কঠোর নজর রাখা হয়েছে এবং আগামীতেও হবে।
নওগাঁ কাস্টমস, এক্সসাইজ ও ভ্যাট বিভাগ সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ কাউছার আলম জানান, গত ২০১৫ সালের জুন থেকে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত খঞ্জনপুর করিডোর দিয়ে ৪০ হাজার ৮৫৬টি গবাদিপশু এসেছে। মাত্র ৯ মাসে রাজস্ব আয় হয়েছে ১ কোটি ৭৭ লাখ ২৩ হাজার টাকা। মূলত বিট মালিকদের দ্বন্দ্বের কারণে করিডোরটি বন্ধ হয়ে যায়।
তিনি আরো বলেন, করিডোরটি চালু করা সম্ভব হলে সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব পাবে। পাশাপাশি এলাকার আর্থ-সামাজিক, রাস্তা-ঘাটের উন্নয়ন হবে, অনেক বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান হবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top