সকল মেনু

ইতিহাস বিকৃতির ফলেই জঙ্গীবাদের সৃষ্টি ॥ হাসিনা

ইতিহাস বিকৃতির ফলেই জঙ্গীবাদের সৃষ্টি ॥ হাসিনা

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অব্যাহত রাখার কথা পুনর্ব্যক্ত করে বলেছেন, বাঙালী বীরের জাতি। বাঙালী জাতি আর আলবদর-রাজাকারদের ক্রীড়নক হয়ে থাকতে চায় না, থাকবেও না। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খুনীরা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে ও দর্প করে বলেছিল- কে তাদের বিচার করবে? আমরা তাদের বিচার করেছি। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। একাত্তরের স্বজনহারানোর মনে শান্তি ও স্বস্তি দিতে আমরা সেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছি, রায়ও কার্যকর করছি। যতই বাধা-বিপত্তি বা হুমকি আসুক, যুদ্ধাপরাধীদের এই বিচার প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দীর্ঘ ২১টি বছর জাতির পিতার নাম নিষিদ্ধ এবং ইতিহাস বিকৃতির উদাহরণ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ’৭৫-এর পর একটি প্রজন্মকে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতেই দেয়া হয়নি। বঙ্গবন্ধুর নাম ও তাঁর ভাষণ বাজানো নিষিদ্ধ ছিল। একটি প্রজন্ম যদি ক্রমাগতভাবে বিকৃত ইতিহাস শুনতে থাকে, তবে তাদের চরিত্রটাও বিকৃত হয়ে যায়। আজকের যে সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ তা সেই বিকৃত ইতিহাস থেকেই সৃষ্টি। দেশ ও জাতির সেবায় যে কোন ত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- যে কোন মহৎ অর্জনের জন্য মহান আত্মত্যাগের প্রয়োজন। তাই দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে, তাদের কল্যাণ ও উন্নত জীবন দিতে আমিও যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত।

বুধবার রাজধানীর খামারবাড়িতে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন অব বাংলাদেশ মিলনায়তনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা মুজিব স্মরণে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। আর ছাত্রলীগের এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগের মাসব্যাপী কর্মসূচী শেষ হলো।

ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগের সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন সিনিয়র সাংবাদিক ও গবেষক সৈয়দ বদরুল আহসান। স্বাগত বক্তব্য রাখেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন। অনুষ্ঠানে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকরা ছাড়াও আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ, মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ, সংসদ সদস্যবৃন্দ এবং বিপুল সংখ্যক ছাত্রলীগের নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন। আলোচনা শেষে ছাত্রলীগের নিয়মিত প্রকাশনা ‘মাতৃভূমি’র মোড়ক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের সঙ্গে জিয়াউর রহমানও জড়িত উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আমরা লন্ডনে এই হত্যার তদন্তে একটি কমিশন গঠন করি। টমাস উইলিয়ামকে এই তদন্ত কমিশনের প্রধান করা হয়, যাতে বাংলাদেশে এসে তিনি এই হত্যাকা-ের তদন্ত করতে পারেন। কিন্তু জিয়াউর রহমান টমাসকে দেশে আসতে ভিসা দেননি। কেন দেননি? এই হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলেই জিয়া তাকে ভিসা দেননি, একথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

বঙ্গবন্ধুর মহান আত্মত্যাগ ও আদর্শ নিয়ে নিজেদের গড়ে তোলার পাশাপাশি বিশ্বায়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আগামীতে দেশের নেতৃত্ব দেয়ার মতো করে গড়ে তোলার জন্য ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের প্রতিটি অর্জন, আন্দোলন-সংগ্রাম ও আত্মত্যাগে ছাত্রলীগই হলো অগ্রগামী নাম। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা এবং পরবর্তীতে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে এই ছাত্রলীগ। তাই ছাত্রলীগের প্রতিটি নেতাকর্মীকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বুকে ধারণ করে নিজেদের গড়ে তুলতে হবে। নিজেদের উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। ছাত্রলীগের যে বিশাল ভূমিকা ও ইতিহাস রয়েছে তা ধরে রাখতে হবে।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখল এবং তখনকার পরিস্থিতি প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ’৭৫ সালের পর দেশে ১৯টা ক্যু হয়েছে। প্রতি রাতে ছিল কার্ফু। অনেকে বলে জিয়া নাকি (জিয়াউর রহমান) গণতন্ত্র দিয়েছে। গণতন্ত্র নয়, জিয়া দিয়েছিল কার্ফু গণতন্ত্র। তখন (জিয়াউর রহমানের আমলে) স্বাধীনভাবে চলার কোন সুযোগ ছিল না, কথা বলার কোন সুযোগ ছিল না। বঙ্গবন্ধুর আমলে ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী সাজাপ্রাপ্ত ছিল, ২২ হাজার মামলা হয়েছিল। কিন্তু জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করে সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার বন্ধ করে দিলেন। গোলাম আযমকে পাকিস্তান থেকে ফিরিয়ে আনেন।

তিনি বলেন, শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচার বন্ধ করে দিয়ে তাদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেছিলেন এই জিয়াউর রহমান। সে সময় বিবিসিতে ইন্টারভিউতে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে আত্মস্বীকৃত খুনীরা বলেছিল- ‘কে আমাদের বিচার করবে, আমরা বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলেছি।’ মুক্তিযুদ্ধের সেই চেতনাকে ফিরিয়ে আনব বলেই বাংলাদেশে রাজনীতি শুরু করি। বঙ্গবন্ধুর খুনী এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আমরা করেছি, আমরাই করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, স্বজন হারানোর ব্যথা-বেদনা আমার চেয়ে কে বেশি জানে। তাই একাত্তরে যারা স্বজন হারিয়েছেন তারা যেন কিছুটা সান্ত¡না ও স্বস্তি পান সেজন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে।

দেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে ছাত্রলীগের অবদানের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ছাত্রলীগের ঐতিহ্য রয়েছে এদেশের প্রতিটি সংগ্রামে। যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি, বাঙালীর বিজয় মেনে নিতে পারেনি তাদেরই এদেশীয় দোসর ও দালালরা ১৫ আগস্ট ঘটিয়েছিল। এরপর থেকে শুরু হয় বাংলাদেশের ইতিহাস বিকৃতি। এখন আমাদের একটা প্রজন্ম ইতিহাসের তেমন কিছুই জানে না। ’৭৫ থেকে ’৯১ সাল পর্যন্ত ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। তখন বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনতে দেয়া হতো না। সে সময় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাজাতে গিয়ে ছাত্রলীগ নেতা চুন্নসহ অনেককেই জীবন পর্যন্ত দিতে হয়েছে।

ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা পর্যন্ত জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম ও কারাজীবনের সময় তার মা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের অসামান্য অবদানের কথা তুলে ধরতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধুকে অনেক ঝড়ঝঞ্ঝা পাড়ি দিতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে সংগ্রাম করেছেন। তখন নেপথ্যে থেকে বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি পদক্ষেপে পাশে থেকে অনুপ্রেরণ দিয়ে গেছেন আমার মা। নিজের জন্য জীবনে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে কিছু চাননি। বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ কারাজীবনের সময় শুধু সংসার চালানোই নয়, অসংখ্য মামলা মোকাবেলা এবং সংগঠন পরিচালনার কাজও করে গেছেন বঙ্গমাতা। ছাত্রলীগকে নিজে দেখাশোনা করতেন, অর্থ-পরামর্শ দিতেন। কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু যে মেসেজ বা নির্দেশ দিতেন, তা আমার মা ছাত্রলীগের মাধ্যমেই আওয়ামী লীগের নেতাদের দিতেন, সেভাবেই আন্দোলন-সংগ্রাম হতো।

একরাতে সব স্বজনহারানোর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বার বার আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা। আবেগজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, বাবা-মা, ভাইসহ সবাইকে রেখে আমরা দু’বোন বিদেশে গেলাম। কিন্তু দেশে যখন ফিরে এলাম কাউকেই দেখতে পেলাম না। সব হারানোর ব্যথা নিয়ে দেশে ফেরার পর কোটি বাঙালীর স্নেহ-ভালবাসা পেয়েছি, তাদের মধ্যেই আমার হারানো বাবা-মা-ভাইদের খুঁজে পেয়েছি, প্রেরণা ও সাহস পেয়েছি। তিনি বলেন, স্বাধীনতা অর্জনে আমার মায়ের অবিস্মরণীয় অবদানের কথা খুনীরা আগে থেকে জানত বলেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার মাকেও হত্যা করা হয়। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর কথা সবাই বলেন, কিন্তু আমার মা’রও যে অবিস্মরণীয় অবদান ছিল এদেশের জন্য তা অনেকেই বলেন না। মায়ের সেই অবদানের কথা আমি সময় পেলেই লিখে রাখছি বলেও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।

ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি ছাত্রদের হাতে কাগজ-কলম তুলে দিয়েছি। আর জিয়াউর রহমান ছাত্রদের হাতে অর্থ-অস্ত্র ও ড্রাগ তুলে দিয়ে বিপথে নিয়ে গিয়েছিল। ছাত্র সমাজকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। তাই আমি চাই রাজনীতি কর, কিন্তু সবাইকে উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজেদের গড়ে তুলতে হবে। কেননা, তোমাদেরই আগামীতে দেশের নেতৃত্ব দিতে হবে। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী সবাইকে পাঠ করে জাতির পিতার আদর্শে নিজেদের গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, দেশের জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকার করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে তার সরকারের দৃঢ় অঙ্গীকারের কথা পুনর্ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নিয়ে বাংলাদেশ এখন সবদিক থেকে এগিয়ে চলেছে। বঙ্গবন্ধুর আজীবন স্বপ্নই ছিল এদেশের মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান হবে, উন্নত জীবন পাবে। আমার জীবনেরও একটিই মাত্র লক্ষ্য- দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। তাই সব হারানোর ব্যথা বুকে পাথরচাপা দিয়ে দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছি। আমরা দেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধশালী করে গড়ে তুলবই। এ জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতে আমি প্রস্তুত।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top