সকল মেনু

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় দু’এক মাসের মধ্যেই

1471736867_2

আরাফাত মুন্না ॥ রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে জনসভায় ইতিহাসের ভয়াবহতম নৃশংস ও বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ (তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী) আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতেই এই নারকীয় হামলা চালানো হয়। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলার বিচার শেষ হয়নি দীর্ঘ ১২ বছরেও। বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ পলাতক ১৮ আসামিকেও দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। বিচারিক কার্যক্রমে এ দীর্ঘসূত্রতার জন্য রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষ একে অপরকে দোষারোপ করছে। তবে রাষ্ট্রপক্ষ বলছে এই এক যুগের প্রতীক্ষা এখন শেষ প্রান্তে রয়েছে। দু-এক মাসের মধ্যেই চাঞ্চল্যকর এই মামলার রায় হতে পারে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও জানিয়েছেন শীঘ্রই এই মামলার রায়। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। একটি হত্যা মামলা ও অপরটি বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের মামলা। ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এ মামলা দুটির বিচার কাজ চলছে একসঙ্গে। হত্যা মামলায় মোট আসামি ৫২ জন ও বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের মামলায় আসামি ৪১ জন। সর্বমোট ৫২ আসামির মধ্যে ৩৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৮ জন জামিনে, ২৫ জন কারাগারে আছেন। আসামিদের মধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। বাকি ১৮ পলাতক আসামির অনুপস্থিতিতেই বিচার কাজ চলছে। একই সঙ্গে পলাতকদের দেশে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টাও অব্যাহত আছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

বর্বরোচিত এই হামলায় আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদিকা রাষ্ট্রপতি প্রয়াত জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভী রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। আহত হন কয়েকশ’ নেতাকর্মী। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অভিযোগ রয়েছে, বিএনপি নেতৃত্বাধীন তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ইন্ধনে জঙ্গী সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ (হুজি) ওই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়। এরপর ‘জজ মিয়া’ নাটক সাজিয়ে ঘটনাটিকে অন্যদিকে নেয়ার চেষ্টা করা হয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর দ্বিতীয় দফায় অধিকতর তদন্তে বেরিয়ে আসে হামলার নেপথ্যের নীলনকশা।

মামলার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, এ মামলার বিচার খুব শীঘ্রই শেষ হবে। আড়াই বছর আগে আমার মন্ত্রিত্ব গ্রহণের সময় এ মামলায় ৬১ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছিল। এরপর আড়াই বছরে ২২৪ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। এখন শেষ তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। তারপর যুক্তিতর্ক। এরপর এ মামলার বিচার কাজ শেষ হবে। সেক্ষেত্রে আমার মনে হয়, আমরা এ মামলার শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছি।

আইনমন্ত্রী বলেন, এ মামলাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্য যারা বেঁচে আছেন তাদের হত্যা করতেই ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করা হয়। শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধুর বৃহৎ পরিবার তথা আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করে দেয়ার ষড়যন্ত্রের অংশ ছিল ওই হামলা। এসব ষড়যন্ত্র আমাদের শক্ত হাতে দমন করতে হবে। তবে দেশে আইনের শাসন থাকলে সব আসামিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হয়। সব আইন-কানুন মেনে এ মামলার বিচার কাজ সম্পন্ন করছি। আমাদের উদ্দেশ্য প্রতিহিংসা নয়, আইনের শাসন কায়েম করা।

এ মামলার পলাতক আসামিদের দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, গুরুত্বপূর্ণ এ মামলায় পলাতক আসামিদের দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকারের পক্ষ থেকে সব প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

এক যুগেও বিচার শেষ না হওয়া প্রসঙ্গে এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবী সৈয়দ রেজাউর রহমান বলেন, দীর্ঘদিনেও বিচার শেষ না হওয়ার অনেকগুলো কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো- তদন্তকালে ‘জজ মিয়া’ নাটক সাজিয়ে এ মামলাটি বিপথে নেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। এক পর্যায়ে হামলায় ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেডের উৎস, মজুদ, সংগ্রহ ও বিতরণ সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগপত্রে না থাকায় তা অধিকতর তদন্তের জন্য যায়। অধিকতর তদন্তে এক বছর ১০ মাস ২৯ দিন লেগেছে। এরপর ২০১২ সালের ১৮ মার্চ দ্বিতীয় দফায় অভিযোগ গঠন করা হয়। প্রথম চার্জশীটে আসামি ছিল ২২ জন। অধিকতর তদন্তে আরও ৩০ জন যুক্ত হয়ে মোট আসামি হয়েছে ৫২ জন। তিনি বলেন, সাক্ষ্য গ্রহণ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। মোট ৪৯২ জন সাক্ষীর মধ্যে অতি প্রয়োজনীয় ২২৪ জনের সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, আশা করেছিলাম এ মাসেই মামলা দুটির নিষ্পত্তি হবে। কিন্তু আসামি পক্ষ এ পর্যন্ত ৫ বার হাইকোর্টে গিয়েছে। এর মধ্যে চারবারে ২৯২ কার্যদিবস ব্যয় হয়েছে। আসামিপক্ষ সময়ক্ষেপণের জন্য অনেক সময় অপ্রাসঙ্গিক জেরাও করেছে। এতকিছুর পরও আমরা কাজের প্রায় শেষ পর্যায়ে এসেছি। আশা করছি এ বছরের মধ্যেই দুটো মামলা নিষ্পত্তি হবে।

তদন্তের নামে প্রহসন ॥ গ্রেনেড হামলার পর তৎকালীন জোট সরকার ঘটনা তদন্তে ২০০৪ সালের ২২ আগস্ট বিচারপতি মোঃ জয়নুল আবেদীনকে চেয়ারম্যান করে এক সদস্যের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে। এক মাস ১০ দিনের মাথায় ১৬২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন দিয়ে কমিশন বলে, সংগৃহীত তথ্যপ্রমাণ সন্দেহাতীতভাবে ইঙ্গিত করে এ হামলার পেছনে একটি শক্তিশালী বিদেশী শক্তি জড়িত। তবে প্রতিবেদনে বিদেশী শক্তির নাম নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি।

একাধিক তদন্ত ও চার্জশীট ॥ গ্রেনেড হামলার ঘটনায় মতিঝিল থানায় তৎকালীন এসআই ফারুক হোসেন, আওয়ামী লীগ নেতা প্রয়াত আবদুল জলিল ও সাবের হোসেন চৌধুরী পৃথক তিনটি মামলা করেন। পরে মামলার তদন্ত শুরু করে পুলিশ। হামলার দায় চাপানোর চেষ্টা করা হয় আওয়ামী লীগের ওপর। সাজানো হয় ‘জজ মিয়া’ নাটক। বিষয়টি ফাঁস হয়ে পড়ায় মামলার কার্যক্রম থেমে যায়। পরে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নতুন করে তদন্ত শুরু হয়। ২০০৮ সালের ১১ জুন আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন সিআইডি সিনিয়র এএসপি ফজলুল করিম। এতে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, তার ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন, হুজি নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়। ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর মামলার অধিকতর তদন্ত শুরু হয়। ২০১০ সালের ৩ জুলাই বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, বিএনপির সাবেক যুগ্ম মহাসচিব হারিছ চৌধুরী, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদসহ ৩০ জনকে নতুন আসামি করে সম্পূরক চার্জশীট দেন সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহার আকন্দ।

হামলার দায় স্বীকার ॥ ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার দায় স্বীকার করে এ মামলায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন আট আসামি। তারা হলেন- হুজি নেতা মুফতি হান্নান, মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান ওরফে অভি, শরীফ শাহেদুল আলম বিপুল, মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডাঃ জাফর, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, জাহাঙ্গীর আলম, আরিফ হাসান সুমন ও রফিকুল ইসলাম সবুজ।

পলাতক আসামি ॥ মামলার ৫২ আসামির মধ্যে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, বিএনপির সাবেক এমপি কাজী শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন কায়কোবাদ, হানিফ এন্টারপ্রাইজের মালিক মোঃ হানিফ, ডিএমপির সাবেক ডিসি (পূর্ব) ওবায়দুর রহমান, ডিএমপির সাবেক ডিসি (দক্ষিণ) খান সাঈদ হাসান, লে. কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার, মেজর জেনারেল (অব.) এটিএম আমিন, গ্রেনেড সরবরাহকারী মাওলানা তাজউদ্দিনসহ ১৮ জন আসামি পলাতক আছেন। তাদের ধরিয়ে দেয়ার জন্য ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিস জারি করা হয়েছে।

কারাগারে থাকা আসামি ॥ সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সামরিক গোয়েন্দা অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক রেজ্জাকুল হায়দার, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক আবদুর রহিম, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, হুজি নেতা মুফতি আবদুল হান্নান ওরফে সাব্বিরসহ ২৫ জন আসামি কারাগারে আটক আছেন।

জামিনে থাকা আসামি ॥ এ মামলায় আটজন আসামি জামিনে রয়েছেন। এরা হলেন- খালেদা জিয়ার ভাগ্নে লে. কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক, সাবেক আইজিপি মোঃ আশরাফুল হুদা, শহিদুল হক ও খোদা বক্স চৌধুরী এবং মামলার তিন তদন্ত কর্মকর্তা সাবেক বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সিআইডির সিনিয়র এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান, এএসপি আবদুর রশীদ ও সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার আরিফুল ইসলাম।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top