সকল মেনু

শেখ হাসিনা যেভাবে বেঁচে যান

.২১ আগস্ট, ২০০৪। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে শেখ হাসিনার সমাবেশ মঞ্চের তিন দিকে তিন ভাগ হয়ে অবস্থান নেন ১২ জন জঙ্গি। শেখ হাসিনার বক্তব্য শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দলনেতা জান্দাল মঞ্চের সামনে প্রথম গ্রেনেডটি ছোড়েন। ধারণা ছিল, বিস্ফোরণের পর মঞ্চের সামনের জায়গা ফাঁকা হয়ে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে কাছাকাছি অবস্থান নেওয়া জঙ্গি বুলবুল গিয়ে সরাসরি মঞ্চে শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড ছুড়বেন। কিন্তু প্রথম গ্রেনেডটি বিস্ফোরণের পর ঊর্ধ্বশ্বাসে ছোটা মানুষের ধাক্কায় পড়ে যান বুলবুল। উঠে আর গ্রেনেড ছোড়ার সুযোগ পাননি তিনি। এভাবেই প্রাণে বেঁচে যান মঞ্চে থাকা শেখ হাসিনা, সঙ্গে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারাও।

সিআইডির সাড়ে চার বছরের (২০০৭ থেকে ২০১১ সালের ৩ জুলাই সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়া পর্যন্ত) তদন্ত এবং বিভিন্ন সময়ে সিআইডির রিমান্ডে এবং আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে আসামি মুফতি হান্নান, বুলবুল, জাহাঙ্গীর, বিপুলসহ বিভিন্ন জঙ্গির দেওয়া তথ্য থেকে হামলার এমন চিত্র পাওয়া যায়।

শেখ হাসিনাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার লক্ষ্যে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ওই ভয়াবহ আক্রমণে উগ্র জঙ্গিগোষ্ঠী হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামির (হুজি-বি) ১২ সদস্য সরাসরি অংশ নেন। এই হামলার পরিকল্পনা, প্রস্তুতি, হামলার পর জঙ্গিদের পালাতে সহায়তা এবং তদন্ত ভিন্ন খাতে নিয়ে জড়িত ব্যক্তিদের রক্ষার চেষ্টার অভিযোগে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মন্ত্রী, নেতা ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদেরও আসামি করা হয়েছে সম্পূরক অভিযোগপত্রে।

মামলার অভিযোগপত্র, জঙ্গিদের জবানবন্দি ও তদন্ত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মাঠপর্যায়ে আক্রমণের নেতৃত্বে ছিলেন হুজির দুই কথিত কমান্ডার মুফতি আহসান উল্লাহ ওরফে কাজল (বাড়ি ফরিদপুর) ও মুফতি মঈন উদ্দিন শেখ ওরফে আবু জান্দাল (নড়াইল)। এ দুজন আগের দিন, অর্থাৎ ২০ আগস্ট ঘটনাস্থল ও আশপাশের এলাকা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। এঁদের মধ্যে কাজল পরে ভারতে মারা গেছেন। আর জান্দাল কারাগারে আছেন।

২০০৫ সালের ১ অক্টোবর গ্রেপ্তারের পর মুফতি হান্নান টিএফআই (টাস্কফোর্স ফর ইন্টারোগেশন) সেলে মুফতি হান্নান যে জবানবন্দি দিয়েছেন তাতে বলেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২১ আগস্ট সকাল ১০টার মধ্যে হামলার জন্য নির্বাচিতরাসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা রাজধানীর মেরুল বাড্ডায় হান্নানের আস্তানায় জড়ো হন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন কাজল, জান্দাল, আনিসুল মুরসালিন (ফরিদপুর) ও তাঁর ভাই মহিবুল মুত্তাকিন, মাওলানা আবু বকর (বরিশাল), শাহাদত উল্লাহ ওরফে জুয়েল (নারায়ণগঞ্জ), উজ্জ্বল ওরফে রতন (ঝিনাইদহ), মাসুদ (ঝিনাইদহ), আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল (ঝিনাইদহ), ইকবাল (ঝিনাইদহ), জাহাঙ্গীর আলম (কুষ্টিয়া), মহিবুল ওরফে অভি (গোপালগঞ্জ), রফিকুল ইসলাম ওরফে সবুজ (মাগুরা), খলিল (মাগুরা), শুভ ওরফে তৌফিক (নারায়ণগঞ্জ), আরিফ হাসান ওরফে সুমন (ঢাকার মোহাম্মদপুর), বাবু (টাঙ্গাইল), ফেরদৌস (ঢাকার মিরপুর), ও মাওলানা লিটন ওরফে জোবায়ের ওরফে দেলোয়ার (গোপালগঞ্জ)।

এদের নিয়ে বৈঠক করেন মুফতি হান্নান, মাওলানা আবু সাইদ ওরফে জাফর, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে জাহাঙ্গীর বদর (ঢাকার দোহার), হাফেজ আবু তাহেরসহ আরও কয়েকজন। প্রাপ্ত তথ্যমতে, তাঁরা একটি কক্ষে গোল হয়ে বসেন। মাওলানা আবু সাইদ ওরফে আবু জাফর ও মুফতি হান্নান আক্রমণে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের উদ্দেশে উদ্বুদ্ধকরণ বক্তব্য দেন। তাঁরা আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনাকে ইসলাম ধর্মের শত্রু আখ্যায়িত করেন। বক্তব্য শেষে হামলার নির্দেশনা দেন।

একপর্যায়ে আবু তাহের ও কাজল প্রস্তাব করেন, যাঁদের দাড়ি আছে তাঁদের হামলায় অংশ নেওয়া ঠিক হবে না। পরে আক্রমণের জন্য ১২ জনকে চূড়ান্ত করা হয়। তাঁদের ১৫টি আর্জেস গ্রেনেড দেওয়া হয়। প্রতি দলে চারজন করে তাঁদের তিনটি ভাগে ভাগ করে দেওয়া হয়। এর মধ্যে মঞ্চে আক্রমণের দায়িত্ব ছিল জান্দাল, কাজল, বুলবুল ও লিটনের সমন্বয়ে গঠিত দলের। তাঁদের অবস্থান ছিল মঞ্চের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে।

সবুজ, জাহাঙ্গীর আলম, মাসুদ ও উজ্জ্বলের সমন্বয়ে দ্বিতীয় এবং মুত্তাকিন, মুরসালিন, আরিফ হাসান ও ইকবালের সমন্বয়ে গঠিত তৃতীয় দলটির দায়িত্ব ছিল যথাক্রমে মঞ্চের পশ্চিম ও পশ্চিম-উত্তর দিকে অবস্থান নিয়ে সমাবেশে উপস্থিত জনতার ওপর আক্রমণ করা। জঙ্গিদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, জনতার ওপর আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল নেতা-কর্মীরা মঞ্চের দিকে গিয়ে শেখ হাসিনাকে বাঁচানোর চেষ্টা করার সুযোগ যেন না পান।

টিএফআই সেলে দেওয়া জবানবন্দিতে মুফতি হান্নান বলেন, এই ১২ জনের বাইরে আবু বকর, জুয়েল, খলিল, শুভ, বাবু, ফেরদৌসসহ আরও কয়েকজন গোলাপ শাহ মাজারের মসজিদে অবস্থান নেন। এঁদের মধ্যে ছয়জনকে পাঠিয়েছেন উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু। তাঁরা গোলাপ শাহ মাজারে ছিলেন প্রয়োজনে সহায়তার জন্য। এই ছয়জনকে সিআইডি শনাক্ত করতে পারেনি।

তদন্তে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাড্ডায় মুফতি হান্নানের আস্তানায় দুপুরের খাবার খেয়ে আক্রমণের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা যাঁর যাঁর মতো ঘটনাস্থলে রওনা হন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সবাই আসরের নামাজের আগে গোলাপ শাহ মাজারসংলগ্ন পার্কের কোনায় মসজিদে একত্র হন। সেখান থেকে সমাবেশমুখী আওয়ামী লীগের বিভিন্ন মিছিলের সঙ্গে মিশে ১২ জঙ্গি সমাবেশস্থলে গিয়ে হাজির হন।

বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ট্রাকের ওপর তৈরি সমাবেশ মঞ্চটি ছিল পশ্চিমমুখী। মঞ্চের সামনের দিকে দক্ষিণ পাশে পেট্রল পাম্পের মোড়ের কাছে অবস্থান নেয় জান্দাল, কাজল, বুলবুল ও লিটনের দলটি। সবুজ, জাহাঙ্গীর আলম, মাসুদ ও উজ্জ্বলের দ্বিতীয় দলটির অবস্থান ছিল মঞ্চের সামনের দিকে উত্তর পাশের ফুটপাত ঘেঁষে। আর তৃতীয় দলটির অবস্থান ছিল মঞ্চের পশ্চিম পাশে মোড়ের কাছে।

শেখ হাসিনার বক্তব্য শেষ হতেই প্রথম গ্রেনেডটি ছোড়েন জান্দাল। এরপর জঙ্গিরা যাঁর যাঁর অবস্থান থেকে গ্রেনেড ছুড়তে থাকেন। প্রথম গ্রেনেডের পর মঞ্চের সামনের জায়গা ফাঁকা হলে দ্বিতীয় গ্রেনেডটি মারার কথা ছিল বুলবুলের। কিন্তু মানুষের দিগ্‌বিদিক ছোটাছুটির মধ্যে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যান বুলবুল। শেষ পর্যন্ত তিনি আর গ্রেনেড ছুড়তে পারেননি। পরে সেফটি পিন না খুলেই গ্রেনেড মাটিতে ফেলে পালিয়ে যান।

আসামি জাহাঙ্গীর আলম জবানবন্দিতে বলেছেন, ‘প্রথম গ্রেনেড হামলার পরপর তিনি মঞ্চের উত্তর পাশ থেকে সমবেত মানুষের ওপর একটি গ্রেনেড ছুড়ে মারেন। সঙ্গে সঙ্গে রক্তাক্ত মানুষের চিৎকার ও ব্যাপক হট্টগোল শুরু হলে তিনি ভড়কে যান। ফলে দ্বিতীয় গ্রেনেডটি না ছুড়ে তিনি জনতার সঙ্গে দৌড় দেন এবং গুলিস্তান হকার্স মার্কেটে গিয়ে সেখানকার টয়লেটের ঝুড়িতে বাকি গ্রেনেডটি ফেলে পালিয়ে যান। জাহাঙ্গীর সিআইডির জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, পালানোর পথ, কোথায় টয়লেট আছে—এসব আক্রমণের আগেই তাঁরা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন।

আসামি বুলবুল জবানবন্দিতে বলেন, তিনি জনতার সঙ্গে মিশে দৌড়ে গুলিস্তানের দিকে চলে যান। সেখান থেকে শহর এলাকার একটি বাসে চড়ে গাবতলী যান। গাবতলী থেকে ঝিনাইদহের শৈলকুপায় নিজ বাড়িতে চলে যান ওই রাতেই।

আসামি আরিফ হাসান বলেছেন, তিনি দুটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছিলেন। একটি বিস্ফোরিত হয়েছে। তড়িঘড়ি করতে গিয়ে দ্বিতীয় গ্রেনেডটির সেফটি পিন না খুলেই নিক্ষেপ করেছিলেন। এরপর তিনি সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে দৌড়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন এবং নিউমার্কেটের কাছে গিয়ে মাওলানা তাজউদ্দিনের সঙ্গে দেখা করেন। তাজউদ্দিনের কাছ থেকে আট হাজার টাকা নিয়ে তিনি রাজশাহী চলে যান। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি একটি ছাত্র মেসে গিয়ে আশ্রয় নেন আরিফ। তাজউদ্দিনই এই ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন বলে জানান তিনি।

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শেখ হাসিনাকে হত্যার এই পরিকল্পনা আরও অনেক আগের। হামলার জন্য জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রস্তুত করা হয়েছে অনেক আগে। মুফতি হান্নান, হুজির ডেপুটি চিফ কমান্ডার ঢাকার দোহারের জাহাঙ্গীর বদর ও কাজল (পরে ভারতে নিহত) তাঁদের প্রশিক্ষণ দেন।

অভিযোগপত্রের বিবরণ অনুযায়ী, ২০০৪ সালের ১৮ আগস্ট আবু তাহের, মুফতি হান্নান ও আহসান উল্লাহ ওরফে কাজল মোহাম্মদপুর সুপার মার্কেটের কাছে হুজির কার্যালয়ে বৈঠক করেন। বৈঠকে তাহের বলেন, কেন্দ্রীয়ভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছে, ২১ আগস্ট (২০০৪) শেখ হাসিনার জনসভায় হামলা করা হবে। এ নিয়ে উপমন্ত্রী (তৎকালীন) আবদুস সালাম পিন্টুর সঙ্গেও কথা হয়েছে। এরপর আবু তাহের, মুফতি হান্নান ও কাজল ধানমন্ডির লেকপাড়ে উপমন্ত্রী পিন্টুর সরকারি বাসভবনে যান। সেখানে পিন্টু, তাঁর ভাই তাজউদ্দিন, তাহের, হান্নান ও কাজল পরিকল্পনা নিয়ে আরেক দফা আলোচনা করেন। ১৯ আগস্ট মাওলানা তাহের, কাজল, জান্দাল ও আবদুস সালাম পিন্টু মিরপুর ১ নম্বর পানির ট্যাংকের কাছে মসজিদ-এ আকবর কমপ্লেক্সে আবার বৈঠক করেন। পিন্টু তাঁদের পরদিন তাঁর বাসায় যেতে বলেন। ২০ আগস্ট বেলা ১১টায় জান্দাল ও কাজল ধানমন্ডিতে পিন্টুর বাসায় যান। তাঁদের ১৫টি গ্রেনেড দেন মাওলানা তাজউদ্দিন। পরে তদন্তে এসেছে, এসব আর্জেস গ্রেনেড এসেছে পাকিস্তান থেকে। কাশ্মীর ভিত্তিক সংগঠন হিজবুল মুজাহিদীনের নেতা আবদুল মাজেদ বাট ওরফে আবু ইউসূফ বাট কিছু গ্রেনেড দিয়েছে মাওলানা তাজউদ্দিনকে। যা দেশের ভেতরে বিভিন্ন হামলায় ব্যবহৃত হয়েছে। মাজেদ বাটও ২১ আগস্ট মামলার আসামি এখন কারাগারে আছেন।

জানতে চাইলে এ মামলার রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি সৈয়দ রেজাউর রহমান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, সাক্ষ্য-প্রমাণে উঠে এসেছে যে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য ও শেখ হাসিনাকে হত্যার করার লক্ষ্যে এই গ্রেনেড হামলা করা হয়েছে। তখন মেয়র মোহাম্মদ হানিফসহ অন্যান্য নেতারা মানব ঢাল তৈরি করে শেখ হাসিনাকে রক্ষা করেছিলেন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top