সকল মেনু

শেখ মুজিব॥ শুধু বঙ্গবন্ধু নন বিশ্ববন্ধুও…

শেখ মুজিব॥ শুধু বঙ্গবন্ধু নন বিশ্ববন্ধুও...

 বিশ্বের বাঘা বাঘা নেতারা জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে বিশ্বনেতার মর্যাদা দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শুধু ব্যক্তি কিম্বা রাজনৈতিক দলের জন্য নির্দিষ্ট নয়- তিনি প্রতিষ্ঠান, স্বতন্ত্র, সমগ্র বাঙালি জাতীর মহান নেতা; রাজনীতির কবি।

শেখ মুজিব শুধু বাংলাদেশের নেতা ছিলেন না, এশিয়ারও নন তিনি ছিলেন সমগ্র বাঙালী জাতি এবং বিশ্বের নিপীড়িত, নির্যাতিত মানুষের নেতা। তাঁকে হত্যা করে নিশ্চিহ্ন করা যায়না- বুলেটের আঘাতে তার আদর্শকে কেউ মেরে ফেলতে পারেনি। তাঁর আদর্শ, কর্মচিন্তা আজও উজ্জীবিত। তিনি এমন এক মহানায়ক যা অন্তরে লালন করতেন-কর্মে তা দেখাতেন এবং বিশ্বের বুকে উ”চারণ করতেন সেইসব নিষ্পেষিত মানুষের ধ্বনি যার ফলে লাখো লাখো মানুষ মুষলধারার বৃষ্টির ভেতর মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তার কবিতা শুনতেন-যা ছিলো বাঙালির মুক্তির মন্ত্র।

বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের পর তাঁকে যারা পরবর্তী নেতাদের সাথে তুলনা করেন তারা শিক্ষিত মুর্খ। খোদ পাকজান্তারা যুদ্ধের পর তাদের স্মৃতিচারণ মূলক গ্রন্থে’ বলেছেন : শেখ মুজিব ১৯৪৮ সাল থেকে এ যাবৎ ১০ বছর পাকিস্তানের জেলহাজতে বন্দী ছিলেন। তিনি দেশদ্রোহী নন তিনি দেশপ্রেমিক-বাঙালী জাতির মুক্তির দূত।’ ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু ‘জুলিও কোরি’ পুরষ্কার পান-অনুষ্ঠানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতারা শেখ মুজিবকে ; ‘বিশ্ববন্ধু’ বল অভিহিত করেন। দেশ স্বাধীনের পর ইন্দিরা গান্ধী তার সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তÍ নেন ১৭ মার্চ বঙ্গন্ধুর জন্মদিনে। বঙ্গবন্ধু তাকে জিজ্ঞাসা করলেন বিনয়ের স্বরে-ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, এক্সসেলেন্সি, এ দিন বিশেষ দিন-আপনার শুভ জন্মদিন। তাই আমি এ দিনে আমাদের ভারতীয় সৈন্য আপনার স্বাধীন দেশ থেকে প্রত্যাহার করে আপনাকে উইশ করতে চাই। গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ভবিষ্যদ্বাণী করছিলেন, শেখ মুজিব একদিন ইতিহাস সৃষ্টি করবে।’ সোহরাওয়ার্দীর এই কথা সত্যে পরিণত হয়েছিল- ২৩ বছরের পাকিস্তানের সামরিক দুঃশাসন থেকে বাঙালীর স্বাধীনতার সূর্য সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত এক দেশের মাধ্যমে ছিনিয়ে আনলেন। মাওলানা ভাসানী তাঁকে সন্তানের মতো স্নেহ করতেন এবং তাঁর ব্যাপারে তিনি আশাবাদী ছিলেন। সূর্যসন্তান শেখ মুজিবুর রহমান সত্যর্থেই যুগান্তরী। দেশ স্বাধীন করলেন-ইতিহাস গড়লেন। তাঁর ব্যক্তিত্ব, চরিত্র, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, গভীর দৃষ্টিজ্ঞান এবং বাগ্মীতায় বাঙালী জাতি অভূতর্পব এক নেতাকে তাদের অন্তÍরে চিরঠাঁই দিয়েছেন।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল জনসভায় ৭ মার্চের বিস্ময়কর ও কালজয়ী ভাষণের পর বিখ্যাত সাময়িকী উইকলি নিউজ প্রকাশ করলেন : “এ পোয়েট অব পলিটিক্স’’-। রাজনীতির এ কবি প্রসঙ্গে ভারতের রাষ্ট্রপতি এপিজে কালাম বলেছেন : শেখ মুজিব ‘ঐশ্বরিক আগুন’। তিনি তাঁর নেতৃত্বে এদেশের মানুষকে সেই মুক্তির পথ দেখিয়েছেন। যে পথ পূর্বে আর কেউ দেখাতে পারেনি।’ বঙ্গবন্ধরু আত্মত্যাগ, আজন্ম লালিত স্বপ্নের বাস্তবায়ন তাকে ব্যক্তি থেকে প্রতিষ্ঠানে, দেশ থেকে বিশ্বে, কাল থেকে মহাকালের শাশ্বত পথের দিকে ধাবিত করেছে। অন্যায়কে প্রতিরোধ, অবিচারকে প্রতিহত, শৃঙ্খলকে বন্ধনহীন করার মধ্য দিযে তার ঐশ্বরিক আগুন জ্বলে উঠেছে বারংবার। যার ফলশ্রুতিতে বাঙালী জাতি পেয়েছে তাদের বহু প্রতীক্ষিত নেতাকে, স্বাধীনতাকে।’

১৯৭১ সালে অসংখ্য বাঙালীদের মতোই বেশ কিছু বিদেশী নেতা ও কবি-সাহিত্যিকরা ছিলেন যারা বিশ্বাস করতেন শেখ মুজিবের নেতৃত্বে এই দেশ স্বাধীন হবে। এলেন্স গিন্সবার্গ তাঁর বিখ্যাত গন্থ’ ‘অনডিউটি ইন বাংলাদেশ’ গ্রন্থে’ মূল্যায়ন করে এভাবে লিখেছেন : এমন একজন মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে যে অনগ্রসর বাঙালী জাতীকে মুক্তির আস্বাদ দিবে। তাঁর নাম শেখ মুজিবুর রহমান।’ ১৯৭১ সাল এবং তৎপরবর্তী শেখ মুজিব বিশ্বনেতাদের চোখে হয়ে উঠেন বিস্ময় ঘোরলাগা এক ব্যক্তিত্ব। তৎকালীন বিশ্বমিডিয়াও তাকে যথার্থভাবে মূল্যায়ন করতে সক্ষম হয়েছিল। ইয়াসির আরাফত বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলেছেন : আপোসহীন সংগ্রামী নেতৃত্ব এবং কুসুমহৃদয় ছিল মুজিব চরিত্রের বৈশিষ্ট্য।’ সম্মান বা পদমর্যাদার দিকে তার কোন নজর ছিলনা; সম্পূর্ণভাবে আন্তরিক ছিলেন জনগণের প্রতি। বাঙালীরাও তাকে গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন। মুহাম্মদ ফরিদ হাসান ‘বঙ্গবন্ধু এক ঐশ্ব^রিক আগুন’ প্রবন্ধ লিখেছেনঃ তাঁর সততা, সংগ্রাম, আত্মত্যাগ এবং নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার প্রতিও জনগণ আন্তরিকভাবেই বিশ্বাস করতেন। মূলত মুজিব চরিত্রে আবেগ, বাগ্মীতা, সাহসিকতা ও ত্যাগের অপূর্ব সম্মিলন ঘটেছে যার ফলে তিনি পরিণত হয়েছিলেন মহানায়কে। বিশ্বের বড় বড় নেতা মুজিবের বাগ্মীতা সম্পর্কে অবগত ছিলেন। মাুনষের ভালোবাসায় সিক্ত এই নেতা জনগনকে সর্বদা আপন ভেবেছেন। অন্যায় ও অপশাসনের বিরুদ্ধে তাঁর কন্ঠস্বরও এমন ছিলো যে মৃত্যুভয়ও তাকে কুণ্ঠিত করতে পারেনি।

জেল-জুলুম নিপীড়নের মাধ্যম শাসকগোষ্ঠী শেখ মুজিবকে দমাতে চেয়েছে কিন্তু বাঙলার মেহনতি মানুষের সম্মিলিত কণ্ঠধারকের স্বর থেমে যায়নি। বরং বিরুদ্ধে স্রোতে ও পথ চলেছেন অবিরাম, স্বপ্ন দেখেছেন সোনার বাংলার। তাঁর এবং সাতকোটি মানুষের স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল যুদ্ধ জয়ের মধ্য দিয়ে। একারণে তিনি মহৎ এবং মহান।’’ গত কয়েক শতকে দক্ষিণ এশিয়ায় অনেক নেতার আবির্ভাব হয়েছিল সবার থেকে শেখ মুজিব সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা হিসেবে স্বীকৃত। লেনিন, ফিদেল কাস্ট্রোর মতো বঙ্গবন্ধুও সফল সেতা ছিলেন। ফিদেল ক্যাস্ট্রো বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলেছিলেন: আমি হিমালয় দেখিনি, তবে শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তি ও সাহসে এ মানুষটি হিমালয়ের সমতূল্য।’ মানবতাবাদী মনীষী লর্ড ফেনার ব্রকওয়ে আরও একধাপ এগিয়ে দেখেছেন এভাবেঃ ‘জর্জ ওয়াশিংটন, মহাত্মা গান্ধী, ডি ভ্যালেরারও চেয়েও শেখ মুজিব এক অর্থে বড় নেতা। শেখ মুজিবের সাহসিকতা ও ব্যক্তিত্ব কেবল দক্ষিণ এশিয়া নয় সারাবিশ্বে বিরল। ফ্রান্সের বিখ্যাত সাহিত্যিক আঁদ্রে মালরো বলেন, স্টালিন নয়, হিটলার নয়, মাওসেতুং নয়-মহাত্মা গান্ধী ও শেখ মুজিবুর রহমান যদি জগত এখনও না বুঝে থাকে এঁদের মতের মর্মবাণী তবে সময় এসেছে এ বিষয়ে দষ্টি উন্মোচনের।’

শেখ মুজিবুর রহমান নিজের ভাবনা সম্পর্কে তাঁর আত্মজীবনীতে বলেছেন : একজন মানুস হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই ভাবি আমি। একজন বাঙালী হিসাবে যা কিছু বাঙালীদের সাথে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালবাসা, অক্ষয় ভালবাসা, যে ভালবাসা আমার রাজনীতি ও অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’ নিজের সম্পর্কে নিজের এ নিরেট সত্য মত ও মতামত মানুষ হিসেবে তাকে আর সব নেতাতের থেকে পৃথক করেছে। একারণেই তিনি বিশ্বনেতা। সমগ্র বাঙালী জাতিরই নেতা। তিনি শুধু বঙ্গের বন্ধু নয় সারাবিশ্বেরও বন্ধু। ঘাতকেরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট হত্যা করলেও তাঁর আদর্শকে হত্যা করতে পারেনি। কারণ আদর্শ হত্যা করা যায়না। ৭ই মার্চে সোহারাওয়ার্দীর বিশাল জনসমুদ্রে লাখো জনতার ঢলে বাগ্মী বঙ্গবন্ধু যখন সেই ঐতিহাসিক কবিতাখানি উচ্ছারণ করলেন ‘‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’’ সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি মুক্তিকামী বাঙালীর। শুধু তাই নয় সদ্য স্বাধীনতা অর্জিত বাংলাদেশের কন্ঠমণি-বিশ্ববীর বঙ্গবন্ধু নিষ্পেষিত, সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য জাতিসংঘে ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বব ৫০টি ইস্যুর কথাও বাংলা ভাষায় সটান বুকে ভাষণ দিয়ে গেলেন বিশ্বের রথী-মহারথী নেতাদের সামনে যা আজও মানবজাতিকে নাড়া দেয়। বঙ্গবন্ধু আজ শুধু বিশেষ কোন ব্যক্তি কিম্বা কোন দলের শুধু নয় তিনি সমগ্র বাঙালী জাতির মুক্তির কান্ডারী। বঙ্গবন্ধু আজ ইন্সটিটিউট-রাজনীতির প্রতিষ্ঠান।

সততা-শুদ্ধিতে সর্বোপরি সৎ, আত্মত্যাগে সাহসি সৈনিক, দেশপ্রেমে ময়ূখ যারা, জাতির সুখ ও সমৃদ্ধি এবং ভবিষ্যভাবনায় সর্বদা তাড়িত থাকেন তারাই কেবল উত্তরাধিকার এ প্রতিষ্ঠানের। বঙ্গবন্ধুকে কোনোভাবেই খন্ডিত বা বিভক্ত করা যায়না কেননা তিনি কেবল বাংলাদেশের নয় সারা পৃথিবীর নেতা হয়ে বেঁচে থাকবেন ভীষণ সত্যি এবং ইতিহাস তাই-ই। ১৯৭৫’এর ১৫ আগস্টের ঘাতকরদের অবশিষ্ট যাদের এখনো বিচার হয়নি তাদের রায় কার্যকর করে কলঙ্ক থেকে বাঙালীজাতি হিসাবে দায় মুক্ত হওয়া। বিশ্ববন্ধু বাঙালী জাতির অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত বিনির্মাণের কারিগর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে যথাযথ মর্যাদায় প্রজন্মের কাছে উপস্থাপন করা এবং সকল কুতর্কের অবসান ঘটিয়ে ইতিহাসের অদ্ভুত আন্ধার থেকে আলোকিত সোবুজ বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত করা প্রতিটি বাঙালীর বীরোচিত কর্তব্য…।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top