স্টাফ করেসপন্ডেন্ট,হটনিউজটোয়েন্টিফোরবিডি.কম,ঢাকা: রাজধানীসহ সারাদেশে চলছে দূষিত রক্তের রমরমা বাণিজ্য। আর লাইসেন্সবিহীন অবৈধ ব্লাড ব্যাংকগুলো মাদকাসক্ত ও পেশাদার রক্তদাতাদের রক্ত নিয়ে এ বাণিজ্য করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
রক্তদাতাদের কাছ থেকে সুলভ মূল্যে রক্ত কিনে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল এবং ক্লিনিকে উচ্চমূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে এ বিষাক্ত রক্ত।
চাঁনখারপুল, বকশীবাজার, শেরেবাংলা নগর, মিরপুর, মহাখালী, মিটফোর্ড, ধানমন্ডি, রাজধানীর ঘনবসতি এলাকা, অলিগলিসহ দেশের ছোট ছোট শহরগুলোতেও ব্লাড ব্যাংক এবং প্যাথলজি সেন্টারে চলছে এ রক্ত বেচাকেনার ব্যবসা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সূত্র মতে, ২০১২ সাল পর্যন্ত রাজধানীতে লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্লাড ব্যাংকের সংখ্যা ছিল ৪১টি। কিন্তু, রাজধানী ও আশেপাশের এলাকায় ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা লাইসেন্সবিহীন অবৈধ ব্লাড ব্যাংকের সংখ্যা প্রায় ছয় শতাধিক।
বেসরকারি এক জরিপ মতে, দেশে প্রতিবছর রক্তের চাহিদা রয়েছে প্রায় ছয় লাখ ব্যাগ। এর মধ্যে ৭০ ভাগ সংগৃহীত হয় পেশাদার রক্তদাতাদের কাছ থেকে।
আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে, এ সব পেশাদার রক্তদাতাদের মধ্যে রয়েছেন মাদকাসেবী, যৌনকর্মী এমনকী মরণব্যাধি এইচআইভি জীবাণুবাহীরা।
মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র সারডা-এর চিকিৎসক সাদাত হটনিউজকে জানান, এইসব রক্তগ্রহণে রোগীর মৃত্যু অনেকাংশেই নিশ্চিত থাকে। নেশার উপকরণ কেনার জন্য তরুণ-তরুণীরা রক্ত বিক্রি করছেন।
তিনি জানান, মাদকাসক্ত নারী-পুরুষের রক্তে মরণব্যাধি এইডস ও হেপাটাইটিস বি-ভাইরাসসহ নানা ধরনের সংক্রামক ব্যাধির জীবাণু থাকার আশঙ্কা শতভাগ।
তিনি জানান, মাদকাসক্তদের মধ্যে অনেকেই নেশার ইনজেকশন প্যাথেডিন ব্যবহার করে থাকেন। এই ইনজেকশন পুশ করার একই সিরিঞ্জ ও নিডল একসঙ্গে সাধারণত পাঁচ থেকে ছয়জন ব্যবহার করেন। এই সিরিঞ্জ ও নিডলের মাধ্যমে মরণব্যাধিসহ সংক্রামক ব্যাধির জীবাণু সহজেই একজনের শরীর থেকে অন্যের শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রক্ত সংগ্রহের সময় পাঁচটি সংক্রামক ভাইরাস যেমন এইডস, হেপাটাইটিস এ ও বি, ম্যালেরিয়া, সিফিলিস জীবাণু পরীক্ষা বাধ্যতামূলক। কিন্তু, ব্লাড ব্যাংকগুলোতে তা করা হচ্ছে না।
বেশির ভাগ ব্লাড ব্যাংক গড়ে উঠেছে অপরিচ্ছন্ন ঘরে। এ ছাড়াও বাসাবাড়ি, মুদির দোকান অথবা বস্তির ভেতরে থাকা ফ্রিজে রাখা হয় এ রক্ত। জরুরি মুহূর্তে অনেকেই বিপদে পড়ে এ দূষিত রক্ত কিনতে বাধ্য হচ্ছেন।
রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র বিধিমালা অনুযায়ী, একটি ব্লাড ব্যাংকে একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, একজন ডিউটি ডাক্তার ও একজন টেকনিশিয়ান থাকা বাধ্যতামূলক হলেও অবৈধ ব্লাড ব্যাংকগুলোতে রয়েছে মালিক, কয়েকজন দালাল, একজন মার্কেটিং ম্যানেজার ও একজন অফিস কর্মচারী।
এ সব অবৈধ ব্লাড ব্যাংকের মালিক প্রতিষ্ঠানে মূলধনের যোগান দেন। আর দালালদের কাজ থাকে নির্দিষ্ট এলাকার মাদকাসক্তদের চিহ্নিত করে তাদের বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে সুলভ মূল্যে রক্তপ্রদানে বাধ্য করা।
মার্কেটিং ম্যানেজার রক্ত বিক্রির কাজে বিভিন্ন মেডিকেলের আশেপাশে ঘুরে বেড়ান। যাদের রক্ত প্রয়োজন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আকর্ষণীয় কমিশনে রক্ত প্রদানের বিনিময়ে বিভিন্ন হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি করেন। আর অফিস কর্মচারী রক্তদাতাকে ভুয়া কাগজপত্র প্রদানসহ রক্তের বিনিময়ে অর্থ প্রদান করেন।
একজন রক্তদাতাকে সর্বোচ্চ দুইশ ৩০ থেকে তিনশ টাকা দেওয়া হয়। আর হাসপাতালে বিভিন্ন গ্রুপের চাহিদা অনুযায়ী আড়াই থেকে তিন হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়।
চানখারপুলের ব্লাড ব্যাংকের এক পেশাদার রক্তদাতা খালেদ এহসান হটনিউজকে জানান, অনেক মাদকসেবী ব্লাড ব্যাংকে এসে নিজেদের সাঙ্কেতিক নামে পরিচয় দেন। রক্ত বিক্রি করে পরে তারা মাদক কিনতে যান।
তিনি জানান, অনেক রক্ত ব্যবসায়ী আবার মাদকসেবীদের কাজ সহজ করতে টাকার পরিবর্তে মাদকও সরবরাহ করে।
এ সময় খালেদ মাসে একাধিকবার রক্ত দেওয়ার কথাও হটনিউজের কাছে স্বীকার করেছেন।
খালেদ আরো জানান, মাদকসেবীরা প্রতিদিন মধ্যরাতে ও খুব ভোরে অবৈধ এই ব্লাড ব্যাংকগুলোর সামনে আসে। সকাল ৬টা থেকে ৮টা ও রাত ১২টার পর দু’ফায় রক্ত সংগ্রহ করা হয়, এ সব মাদকসেবীদের কাছ থেকে। সংগৃহীত রক্ত খুব দ্রুত সরিয়ে ফেলা হয় নিরাপদ স্থানে।
র্যাব ও মোবাইল কোর্টের অভিযানের পরেও তাদের এই ব্যবসা থামানো যাচ্ছে না। এ বছরের জানুয়ারি থেকে কয়েকদিন আগ পর্যন্ত রাজধানীর চাঁনখারপুল, বকশীবাজার, মহাখালী, মিটফোর্ড, ধানমন্ডি, মগবাজারে অভিযান চালিয়ে শতাধিক ব্যাগ রক্ত বিনষ্ট করা হয়।
সর্বশেষ ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক এএইচএম আনোয়ার পাশার নেতৃত্বে ৯ জুলাই মগবাজারের ব্লাড ব্যাংকগুলোতে অভিযান চালিয়ে পাঁচজনকে সাজা দেওয়া হয়।
অভিযোগ ছিল, ব্লাড ব্যাংকগুলোতে হিমোগ্লোবিনসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার কেমিক্যাল নেই। পরীক্ষা ছাড়াই তারা ভুয়া রিপোর্ট তৈরি করে রক্ত বিক্রি করতো। প্রায় সব অবৈধ ব্লাড ব্যাংকে একইভাবে ভুয়া রিপোর্ট তৈরি করা হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক বার বার কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হলেও লাইসেন্সবিহীন এইসব অবৈধ ব্লাড ব্যাংক দমনে তেমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।