সকল মেনু

রোয়ানুর ধাক্কায় ম্লান ঈদ-আনন্দ

images চট্টগ্রাম প্রতিনিধি :  মলিন মুখ। কারও ঘরেই ঈদের বিশেষ প্রস্তুতি নেই। তিনবেলা খাবার জোগাড়েই ঘাম ঝরছে। সেহরিতে মরিচ-ভাত, আর ইফতারে মিলছে সামান্য ছোলা-মুড়ি।

মাত্র এক মাস আগে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর ক্ষতচিহ্ন এখনও ঘরে ঘরে। বাড়িতে এক হাঁটু জল। কর্মহীন মানুষগুলোর কাছে ঈদ-প্রস্তুতির চেয়ে কাজের খোঁজটাই প্রধান। কেউ কাজের খোঁজে শহরে, কেউ বা ত্রাণের আশায় চেয়ারম্যান-মেম্বারের কাছে। পরিবারের সর্বকনিষ্ট সদস্যের ঈদ-আবদার পূরণ করাও কারও পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।

চিত্রটা চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার সমুদ্র তীরবর্তী খানখানাবাদ ইউনিয়নের। রোয়ানুর প্রভাবে ইউনিয়নের খানখানাবাদ আর কদমরসুল গ্রামের বেড়িবাঁধ ধসে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হয়। মাত্র এক মাস আগের এই দুর্যোগের ধাক্কা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি এলাকার মানুষেরা। এখানে কাজ ও খাদ্যের অভাব তীব্র আকার ধারণ করেছে।

ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার বাসিন্দারা জানালেন, রোয়ানু বহু ঘরের বহু সম্পদ ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। জমির ফসল বিনষ্ট হয়েছে। পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। মিঠা পানির পুকুর এখন লবণ পানিতে পূর্ণ। কৃষি জমিতে লবণ পানি। বহু মানুষ পথে বসেছে।

এলাকা ঘুরে চোখে পড়ল জরুরি বাঁধ মেরামতের কাজ চলছে। কিন্তু তা এতটাই নড়বড়ে যে, ছোটখাটো ধাক্কাও সইতে পারে কিনা সন্দেহ। এলাকার মানুষের দাবি উঁচু শক্ত বাঁধ, যাতে তারা নিরাপদে বসবাস করতে পারেন।

ঈদ সামনে রেখে খানখানাবাদ ইউনিয়ন পরিষদ থেকে বিতরণ করা হচ্ছে পরিবার প্রতি ১৫ কেজি করে চাল। রোয়ানু ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার এই সহায়তা পাচ্ছে। প্রেমাসিয়া গ্রামে যাওয়ার পথে কদমরসুলে দেখা হলো কয়েকজন নারী-পুরুষ ও শিশুর সঙ্গে। সবার মাথায় চালের বস্তা। বেড়িবাঁধ বিধ্বস্ত হওয়ায় প্রায় এক কিলোমিটার কাদাপানির পথ অতিক্রম করে চাল নিয়ে ফিরছিলেন এরা।

এক শিশু জানাল, সেই ভোর ৬টায় বেরিয়েছে বাড়ি থেকে। ত্রাণের চাল নিয়ে ফিরতে বিকেল গড়িয়েছে। কষ্ট করে ত্রাণ নিলেও এতে ঈদের কোনো চাহিদা মিটবে না।

খানখানাবাদ গ্রামের মাহবুব আলী (৪৫)। ত্রাণের চাল পেয়েছেন ১৫ কেজি। সঙ্গে ভাইয়ের মেয়ে উর্মি আকতার (১০) আর আরেক ভাইয়ের মেয়ে ইয়াসমিন (১২)। সবার মাথায় চালের বস্তা। মাহবুব আলী জানালেন, এবার তাদের কোনো ঈদ হবে না। তিনবেলা ভাত খাওয়াই কষ্ট, সেখানে ঈদের প্রস্তুতি নিব কীভাবে?

খানখানবাদ গ্রামের ওসমান গনির দশ বছরের ছেলে শওকত হোসেন ত্রাণের চাল নিয়ে বাড়ি ফিরছিল। কদমরসুল গ্রামের মীর আহম্মদের ছেলে আরফাতুল ইসলাম (১২) এবং নূর মোহাম্মদের মেয়ে মিশু আকতার (১১) ও জোবায়দা নাহারও শওকত হোসেনের দলে। ওরা জানাল, বাড়িতে তিনবেলা ভাত খেতে পায় না তারা। ঈদের কাপড় কিনবে কিভাবে।

রোয়ানুর পর খাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দেওয়ায় শহরে কাজের খোঁজে গিয়েছিলেন কদমরসুল গ্রামের নোয়াপাড়ার বাসিন্দা মো. শাহজাহান (৪৫)। এলাকায় বাঁধ মেরামতের কাজ হচ্ছে খবরে বাড়ি ফিরেছেন। সপ্তাহব্যাপী বেড়িবাঁধ মেরামতের কাজ করছেন, মিলছে দৈনিক ৪০০ টাকা। এ দিয়ে আপাতত মোটামুটি সংসার চলছে। আরও এক সপ্তাহ এই কাজ চলবে। কাজ শেষ হলে তাকে আবার শহরে ছুঁটতে হবে।

শাহজাহানের ঘর বেড়িবাঁধের ঢালে। এখানে আছেন প্রায় ১০ বছর ধরে। এর আগে ছিলেন এখান থেকে খানিক দূরে। পানি ওঠায় চলে এসেছেন বাঁধের কিনারে। আশ্বেদ আলী আর নূর ইসলামের (মৃত) পরিবারও এখানে থাকে। সবাই আছে চরম ঝুঁকির মধ্যে। সমুদ্র পাড়ের বাসিন্দা হয়ে সমুদ্রের গর্জনে এরা ভয় না পেলেও আতংক আছেন, কখন জলোচ্ছ্বাসে হারিয়ে যায় বাড়িঘর।

শাহজাহানের স্ত্রী ইয়াসমিন আক্তার বলেন, ছেলেমেয়ের জন্য এবারের ঈদে কিছুই কেনার সুযোগ নেই। দিন শেষে যে রোজগার হয়, তা দিয়ে সবার মুখে খাবার তুলে দেওয়াই কষ্টকর। গোটা রোজায় সেহরি কিংবা ইফতারে বিশেষ কিছুই মেলেনি। ইয়াসমিন আক্তারের প্রতিবেশী সোনিয়ারা বেগম। কথা বলতে বলতে তার চোখ ভিজে গেল। স্বামী নূর মোহাম্মদ সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে তিন বছর আগে প্রান হারিয়েছেন। ঝড়ের কবলে পড়ে মারা যান তিনি। এখন সন্তানদের নিয়ে মহাসংকটে সোনিয়ারা। ঈদের প্রস্তুতি নিয়ে ভাবার কোনো সুযোগ নেই তার।

কদমরসুল গ্রামে কথা হলো বেশ কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দার সঙ্গে। তার হলেন মো. ইউনুস (৬০), কৃষি কাজ করেন। মো. জাহাঙ্গীর (২১) রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। মো. বাবুল (৪০), কৃষি কাজ করেন। তাজুল ইসলাম (৩০), কৃষি কাজ করেন। লাইলা বেগম (৪০), স্বামী আবদুর রহমান।

এরা জানালেন, বাড়ির পাশে সমুদ্র তীরের বেড়িবাঁধ রোয়ানু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ফলে এলাকা পানিতে ডুবে যায়। এলাকার সব মানুষ বিভিন্ন স্থানে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। তবে সকলেই অনেক সম্পদ হারিয়েছে।

কদমরসুল গ্রামের এই বাসিন্দারা জানালেন, বছরে অন্তত পাঁচবার এই এলাকার মানুষ পানিতে ভাসে। সে কারণে জলোচ্ছ্বাসে এদের তেমন ভয় নেই। রোয়ানুর সিগন্যাল পড়লেও এলাকার মানুষেরা ততটা গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু হঠাৎ বাঁধ ভেঙে সবকিছু ভাসিয়ে নেয়। যা এলাকার মানুষেরা ধারণাও করতে পারেনি। তারা জানালেন, এই গ্রামের মানুষের এবার ঈদের আনন্দ নেই।

খানখানাবাদ গ্রামের আলী আকবরের ষষ্ঠ শ্রেণি পড়ুয়া মেয়ে তুর্কী বেগম, মাহফুজুর রহমানের পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়ে রাজিয়া সুলতানা, মাহমুদুর রহমানের ষষ্ঠ শ্রেণি পড়ুয়া মেয়ে ইভা বেগম, আমান উল্লাহর তৃতীয় শ্রেণি পড়ুয়া ছেলে শাহেদুল কাদের, আনোয়ারুল ইসলামের তৃতীয় শ্রেণি পড়ুয়া মেয়ে জোবায়দা আকতারসহ আরও অনেকের সাথে আলাপ হলো ঈদের প্রস্তুতি নিয়ে। সবারই এক কথা, তিনবেলা ভাতই যেখানে জোটেনা, সেখানে ঈদ কিভাবে হবে?

অভিভাবকদের কয়েকজন হাজী মনির আহম্মদ, আজিজ আহমেদ, আনোয়ার হোসেন জানালেন, একটি পরিবারে ঈদ করতে হলে অন্তত দশ হাজার টাকা প্রয়োজন। অভাবের এই দিনে এত টাকা জোগাড় করা তো সম্ভব নয়। কেউ কেউ হয়তো ধারদেনা করে ছেলেমেয়ের আবদার পূরণ করবে, কিন্তু সেটা তো আরেক বোঝা।

আর খানখানাবাদের যেসব এলাকা এখনও পানির নিচে আছে, তার মধ্যে প্রেমাসিয়া গ্রাম অন্যতম। এই গ্রামের বাসিন্দা আবদুস শুক্কুরের সঙ্গে দেখা সমুদ্র তীরে। বললেন, রোয়ানুর পর তিন বার চাল পেয়েছি। এক মাসে প্রায় ১৫ হাজার টাকা কর্জ করেছি। কোনোভাবেই সংসার চালিয়ে নিতে পারছি না। এলাকায় কোনো কাজ নেই। সবাই বেকার হয়ে পড়েছে। এবার তো এই এলাকায় ঈদ হবে না। ঈদে কোথায় যাব? অনেক বাড়িঘরে তো এখনও পানি!

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top