সকল মেনু

নিশ্চিহ্নের পথে কুমিল্লার নজরুল স্মৃতিফলক

49নিজস্ব প্রতিবেদক, হটনিউজ২৪বিডি.কম ৩০ মে : প্রেম ও দ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সময় তৎকালীন কুমিল্লায় কাটানো দিনগুলি। কবির প্রণয়-বিয়েসহ জীবনের অনেক ঘটনার সাক্ষীও কুমিল্লা।

স্বভাবতই বাংলাদেশের জাতীয় কবি নজরুলের সাহিত্যকর্মে অনেকভাবে উঠে এসেছে উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন নগরী কুমিল্লা।

নজরুলের প্রেম, বিয়ে, বিচ্ছেদ, গ্রেফতার, সমাবেশ এবং কাব্য ও সংস্কৃতি চর্চাসহ বহু স্মৃতিকে অম্লান করে রাখতে কুমিল্লার বিভিন্ন জনপদে স্থাপিত হয় কিছু স্মৃতিফলক।

চিরবিদ্রোহী ও রণক্লান্ত কবি নজরুলের স্মৃতিধন্য কুমিল্লায় কবির স্মৃতিকে এতোকাল বহন করে চলছিল  এসব স্মৃতিফলক।

কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে কুমিল্লায় নজরুলের স্মৃতিবাহী নগরীর বিভিন্ন পথে স্থাপিত ১২টি ফলকের মধ্যে ৯টিরই  করুণ দশা। অযত্ন আর অবহেলায় এসব ফলকগুলো নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে।

এদিকে, নজরুলের স্মৃতি বহন করে চলা কয়েকটা ফলক এরই মধ্যে কে বা কারা তুলে ফেলেছে। জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে মুরাদনগরের দৌলতপুরে নজরুলের বাসর ঘরসহ দৌলতপুরে কবির প্রবেশদ্বারের স্মৃতিফলকগুলো।

কবি নজরুল ১৯২১ সালের ৩ এপ্রিল থেকে ১৯২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ৫ বারে এসে মোট ১১ মাস কাটিয়েছেন কুমিল্লায়।

‘আনন্দময়ীর আগমন’ লিখে ব্রিটিশরাজকে নাড়িয়ে দেওয়া কবি তখন আলোচনা ও খ্যাতির তুঙ্গে। ১৯২২ সালের ২৩ নভেম্বর কুমিল্লা নগরীর ঝাউতলা সড়কের শেষ প্রান্তে রাস্তার দক্ষিণ পাশ থেকে ওই কবিতার জন্য গ্রেফতার করা হয় নজরুলকে।

পরবর্তীতে ওই স্থানে নির্মিত হয় একটি স্মৃতিফলক। কালের আবর্তে অবহেলা আর সংরক্ষণের অভাবে আজ সে স্মৃতিফলক ঢাকা পড়েছে ‘শীতক প্রকৌশলীর দোকান’ এর ফেলে রাখা নষ্ট ফ্রিজ ও এসি মেশিন আর বালতিতে।

কুমিল্লায় এসে প্রতিবারই কবি উঠতেন কান্দিরপাড়ে ইন্দ্র কুমার সেনগুপ্ত অর্থাৎ প্রমীলাদের (পরে কবির স্ত্রী) বাড়িতে। সেখানে কবির স্মরণে নির্মিত হয়েছিল একটি স্মৃতিফলক। এখন ওই বাড়ির পুকুরটি ভরাট হয়ে গড়ে উঠেছে বড় বড় ভবন। বাড়িটিও বিক্রি হয়ে গেছে। কবির স্মরণে নির্মিত সেই স্মৃতিফলকের অবস্থাও করুণ।

১৯২১ সালের ২১ নভেম্বর কুমিল্লার রাজগঞ্জ বাজারে নজরুল ব্রিটিশবিরোধী মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন। সেখানেও পরবর্তীতে কবির স্মৃতি স্মরণে নির্মিত হয়েছিল একটি ফলক। তার এখন কোনো খোঁজ নেই। সেখানে এখন ময়লা-আবর্জনা ফেলার ডাস্টবিন রাখা হয়েছে।

কবির স্ত্রী প্রমীলাদের বাড়ির পাশেই ছিল তৎকালীন বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতা বসন্ত কুমার মজুমদারের বাড়ি। সে সময় কবির সঙ্গে পরিচয় ঘটে বাগিচাগাঁওয়ের বিপ্লবী অতীন রায়ের। তখন প্রায়ই ওই সড়ক সংলগ্ন বসন্ত স্মৃতি পাঠাগারে কবি আড্ডা দিতেন ও কবিতা লিখতেন। পরে সেখানে নির্মিত হয় কবির স্মৃতিফলক। বর্তমানে ওই ফলকটি তুলে নিয়ে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা রাস্তার বিপরীত পাশে ফরিদা বিদ্যায়তনের সামনে স্থাপন করেছেন।

নগরীর বজ্রপুরে অবস্থিত কুমিল্লার প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইউসুফ হাইস্কুলের কাছে ছিল অবিনাশ ময়রার দোকান। ওই দোকানের পাউরুটি ও রসগোল্লা ছিল কবির প্রিয়। সেখানেও কবির স্মৃতিতে নির্মিত হয়েছিল ফলক। বর্তমানে ওই মিষ্টির দোকানটি নেই। নেই কোনো ফলকও।

কবি নজরুল কুমিল্লায় অবস্থানকালে বেশ কয়েকবার শহরের দারোগা বাড়ির মাজারের পাশের এক বাড়িতে সংগীত জলসায় জলসায় অংশ নিয়েছেন। নজরুল স্মৃতি রক্ষা পরিষদ ১৯৮৩ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর এই বাড়ির সামনে একটি ফলক স্থাপন করে। ফলকে উল্লেখ করা হয়, ‘বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২১, ১৯২২, ১৯২৩ এখানে গজল গানের মজলিসে যোগ দিয়েছেন। এখানে ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরুসহ অনেক গান গেয়েছেন।’ নজরুলের স্মৃতিবাহী ওই স্থানের কোনো খোঁজ নেয় না কেউ।

নগরীর তৎকালীন মুরাদপুরে দ্বিতীয় মহারাজ কুমার নবদ্বীপ চন্দ্র দেব বর্মণ বাহাদুরের রাজবাড়িতে ১৯২২ সালে নজরুল কুমার শচীন্দ্র দেব বর্মণের সঙ্গে সংগীত চর্চা করতেন।

বর্তমানে কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মো. হাসানুজ্জামান কল্লোলের আন্তরিক প্রচেষ্টায় ওই বাড়িটি সংস্কারসহ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

এছাড়া নানুয়ার দিঘিরপাড়ের সুলতান মাহমুদ মজুমদারের বাড়ি, নবাববাড়ির নজরুলের ম্মৃতিচিহ্ন ফলকগুলোও অযত্নে অবহেলায় নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে রয়েছে।

কুমিল্লার দৌলতপুরেও রয়েছে কবির অনন্য কিছু স্মৃতি। নার্গিসের সঙ্গে বিয়ের রাতেই অজানা কারণে কবি দৌলতপুর ছেড়ে চলে গেলেও এখনো তার স্মৃতি বহন করে চলছে দৌলতপুর। কিন্তু সেসব স্মৃতিচিহ্নও পড়েছে ধ্বংসের মুখে।

দৌলতপুরে নার্গিসদের বাড়ির কবির স্মৃতিধন্য গাছ, পুকুর ঘাট, বাসর ঘর, খাট প্রভৃতি অযত্নে শীর্ণ হয়ে পড়েছে।

কবির সেই বাসর ঘরের খাটে এখন ওই বাড়ির বাসিন্দারা ঘুমান। এমনকি ব্যবহৃত হচ্ছে কবির ব্যবহৃত বালিশ ও কাঁথা। বাসর ঘরটিও আগের অবস্থায় নেই, পুরোটা প্রায় ভঙ্গুর। যে আম গাছের নিচে বসে কবি বাঁশি বাজাতেন সেটিও মরে গেছে।

নার্গিসের মামা আলী আকবর খাঁন মেমোরিয়াল ভবনটিও এখন ধ্বংসের শেষ প্রান্তে। সংস্কার ও সংরক্ষণ না করা হলে এর ধ্বংস অত্যাসন্ন। ওই বাড়িতে বর্তমানে বসবাস করছে আলী আকবর খানের বংশের লোক পরিচয়দানকারী এক পরিবার।

এদিকে, মুরাদনগরের দৌলতপুরে প্রবেশপথেই নির্মিত নজরুল তোরণের দুই পাশে স্থাপিত নজরুলের কবিতা-গানের পঙক্তি সম্বলিত ৫/৬টি ব্যানারও ভেঙে পুলের সঙ্গে ঝুলে রয়েছে। এসব রক্ষায় ও সংরক্ষণে নেই কোনো উদ্যোগ।

এসব বিষয়ে কুমিল্লা নজরুল পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অশোক বরুয়া  জানান, নজরুলের এসব স্মৃতিফলকগুলো অচিরেই সংস্কার করা উচিত। স্মৃতিফলকগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে কুমিল্লার মানুষ একসময় ভুলেই যাবে এ জনপদে কবির পদচারণা ছিল।
হটনিউজ২৪বিডি.কম/এআর

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top