সকল মেনু

পঞ্চগড়ে ৫ জয়িতার জীবন সংগ্রামের কাহিনী

a9bd9cec-a3ad-492a-ba1c-facc929a2d99পঞ্চগড় প্রতিনিধি: পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার বড়িংপাড়া গ্রামের খোদেজা বেগেমের জীবন কাহিনী।
০১। অর্থনৈতিক ভাবে সাফল্য অর্জনকারী এক নারী । ১৯৮৩ সালে নীলফামারী জেলায় একজন কৃষকের সঙ্গে বিয়ে হয়। তিনি ছিলেন ১০ ভাই বোনের মধ্যে প্রথম। বিয়ের পরে দেখেন তার স্বামীর আগের আরও একটি স্ত্রী ও ৩ টি ছেলে সন্তান আছে। বিয়ের ৫ বছরের মধ্যে তারও দুটি ছেলে সন্তান জন্ম হয়। ১০ বছর পরে তার স্বামী শারীরিক অসুস্থ্য হয়ে পরে। স্বামীর অসুস্থ্যতার কারণে খোদেজা বেগম কে সংসারের হাল ধরতে হয়। তিনি জমি চাষ করে সংসার পরিচালনা শুরু করে। ১৯৮৬ সালে আনসার ভিডিপির জেলা কমান্ডার ঢাকা গাজীপুর সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পাঠান। ৬ মাস প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রথমে নীলফামারীতে টেইলারিং দোকান দেন। ২০০০ সালে নীলফামারী থেকে দেবীগঞ্জ চলে আসে। দেবীগঞ্জ থানায় টেইলারিং দোকান দেন। সেলাই এর পাশাপাশি ডেনিস বাংলাদেশ লেপ্রোসি মিশন(কমিউনিটি প্রোগ্রাম) থেকে দুঃস্থ্য ও প্রতিবন্ধি মহিলাদের সেলাই প্রশিক্ষণ দেন। তার পর ২০০৫ সালে আনসার ভিডিপি থেকে হাউস ক্রিপিং কাজে সৌদি আরবে গমন করেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো তার সন্তান দুটি ছিল বাংলাদেশে তাই তার মন বিদেশে টিকতেছিল না।তিনি ভাবলেন অর্থ উপার্জন হবে কিন্তু সন্তান মানুষ হবে না তাই দেশে ফিরে এসে দেবীগঞ্জ থানার ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের শিক্ষিত অশিক্ষিত অসহায় পুরুষ মহিলাদের সেলাই প্রশিক্ষণ প্রদান করেণ। বর্তমানে তার কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে ৪০০/৫০০ জন পুরুষ মহিলা বিভিন্ন জায়গায় টেইলারিং দোকান দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে। এইভাবে অর্থ উপার্জন করে সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত ও স্বামীর চিকিৎসা করেন। পূর্বে রাত কাটানোর জন্য তার মাথার উপর ছাদও ছিল না। বর্তমানে ৩ রুম বিশিষ্ট একটি আধাপাকা বাড়ি রয়েছে এবং সন্তান দুটিকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। তিনি মনে করেন তার সন্তান তার অমূল্য সম্পদ।

দেবীগঞ্জ উপজেলার থানা পাড়া গ্রামের পিয়ারী বেগমের জীবন কাহিনী।
০২। শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী এক নারী। পিয়ারী বেগমের শিক্ষা জীবন শেষ হওয়ার আগেই বিয়ে হয়। বিয়ের পর এম এ পাশ করেন। লেখাপড়া শেষ করে স্বামীর সাথে বিদেশে যান। সেখানে দুই বছর থাকার পরে সন্তান হওয়ার জন্য দেশে ফিরে আসেন স্বামীর নির্দেশে। দেশে আসার এক মাস পরে সন্তান প্রসব হয়। তার স্বামীকে সন্তানের ছবি সহ তার খবর পাঠিয়ে দেন। এভাবে ছয়মাস যাওয়ার পর তার স্বমীর কোন যোগাযোগ রাখেন না। অনেক চেষ্ঠা করার পরও তার কোন খোজ খবর পাওয়া যায় নাই। শুরু হলো তার জীবনে অন্ধকারের অধ্যায়। তিন মাস সন্তানকে নিয়ে ভালই কাটছিল বাবার আশ্রয়ে। তিন মাসের মাথায় তার বাবা মারা যায়। তার ভাই তার সন্তানের আর কোন খরচ দিত না। তখন তিনি দিশেহারা হয়ে যায়। সন্তানকে দুধ খাওয়ানোর জন্য নিজের সোনার চুড়ি,আংটি,চেইন বিক্রি করে চলতেন। ১৯৯৫ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকা পদে দরখাস্ত করেণ।১৯৯৫ সালে দেবীগঞ্জ উপজেলায় তার চাকুরী হয়। তার প্রথম নিয়োগ হয় বানিয়াপাড়া প্রাথমিক সরকারী বিদ্যালয়ে। যেদিন তিনি চাকুরীতে যোগদান করেন সেদিন পায়ে তার ভাল একজোড়া সেন্ডেল ছিল না। বর্তমানে তিনি একজন সফল শিক্ষক। প্রতিবছর ভাল ফলাফল হয় এবং পাঠ্যক্রমিকে তারা জাতীয় পুরস্কার (প্রধান মন্ত্রী এ্যাওয়ার্ড) পান। তার বিদ্যালয়টি বিভাগীয় পর্যায়ে ৪ বার শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয় এবং জাতীয় পর্যায়ে একবার শেষ্ঠত্ব অর্জন করে।#

বোদা উপজেলার সাতখামার গ্রামের মজিমা খাতুনের জীবন কাহিনী।
০৩। সফল জননী। ১৯৪১ সালের ১লা জানুয়ারী পঞ্চগড়ের এক নিভৃত গ্রামের জম্ম গ্রহণ করেন।মজিমা খাতুন। শৈশব থেকেই পড়াশুনার প্রতি অদম্য আগ্রহের ফলে স্কুলে ভালো ছাত্রী হিসেবে পরিচিতি পান। অল্প বয়সে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।স্বামীর উৎসাহ অনুপ্রেরণা ও আগ্রহে বিবাহিত জীবনেও তিনি পড়াশুনা চালিয়ে যান। এবং এসএসসি পাশ করেন।১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বামীর পাশাপাশি নিজেও নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগিতা করেন। ১৯৮০-১৯৯০ দশকে তিনি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পঞ্চগড় জেলার একজন সক্রিয় সংগঠক হিসেবে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা,নারী-নির্যাতন প্রেিতরোধসহ নারী উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করেন। প্রত্যন্ত গ্রামের একজন নারী হয়েও তিনি তৎকালিন সকল সামাজিক বৈরিতা ও প্রতিকুলতাকে অতিক্রম করে বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনে নিজেকে সম্পৃত্ত রাখেন। মজিমা খাতুন স্বামীর বেতনের সামান্য টাকায় অভাব অনটনে ও ধারদেনার মধ্য দিয়ে সংসার পরিচালনা করেছেন এবং ৭টি সন্তানকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলায় ব্রতী হন। ১৯৭৪ সালে সরকারী চাকুরী প্রাপ্ত হয়েও সন্তানদের পড়াশুনার স্বার্থে তিনি চাকুরীতে যোগদান করেনি। আর্থিক অনটন দারিদ্র ও নানা মুখি প্রতিকুলাতা অতিক্রম করে সন্তানদের সু-শিক্ষিত হিসেবে গড়ে তোলা ও সকলেই সমাজে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় তিনি স্থানীয়ভাবে একজন অনুকরণীয় নারী ও সফল জননী হিসেবে পরিচিত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও প্রগতিশীল চিন্তার ধারক ও জননী বর্তমানেও নানাভাবে সামাজিক ও নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছেন।

তেঁতুলিয়া উপজেলার রণচন্ডি গ্রামের তাহমিনা আক্তার ময়নার জীবন কাহিনী।

০৪। নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু যে নারী ঃ তাহমিনা আক্তার (ময়না) পিতা-মোঃ আব্দুল মালেক,মাতা-মোছাঃ রওশনারা বেগম। ময়না পরিবারে ৪ ভাই ৮ বোনের মধ্যে ৬ষ্ঠ। ষষ্ঠ শ্রেণীতে অধ্যয়নরত অবস্থায় বখাটে জেঠাতো ভাইয়ের প্রলোভনে অবুঝ প্রেমে জড়িয়ে পড়ে। এবং জেঠাতো ভাইয়ের সাথে তার বিবাহ হয়। বিবাহের পর শরীরের হলুদের রং মিশে যেতে না যেতেই তার দাম্পত্য জীবনে নেমে আসে অন্ধর্কা তার স্বামী তাকে শারীরিক ও মানষিক নির্যাতন শুরু করে। স্বামীর অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে মনের ক্ষোভে ও দুঃখে ৪ মাসের অন্তঃস্বত্তা অবস্থায় সকলের অগোচরে নাইট কোচে চড়ে ঢাকা পালিয়ে যায়। সেখান হতে তিনি আবার বাসায় ফিরে এসে স্বামীর বাড়ি ফিরে যায়। সেখানে তার একটি কন্যা সন্তান জন্ম হয়।কিন্তু স্বামীর নির্যাতনের মাত্রাও বাড়া শুরু করে। ময়না তার বাবার কথামত সেখান থেকে তালাক নেয়। দীর্ঘদিন পর সব লজ্জা মেনে নিয়ে আবার ৯ম শ্রেনীতে পড়াশুনা শুরু করেন। ২০১০ সালে এস এসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়ে এলাকায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। ২০১২ সালে বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়ে উত্তীর্ন হয়। এর পর বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহ-এ ভেটেরিনারী অনুষদে (ডিভিএম) ভর্তি হন। বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহ এ ৩য় বর্ষের একজন অধ্যয়নরত ছাত্রী। তিনি তার কন্যা সন্তানকে তার সৎ মায়ের নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বাসায় নিয়ে আসেন। তার কন্যা এখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩য় শ্রেণীর একজন ছাত্রী। তার পিতা একজন ক্যান্সার রোগী।

বোদা উপজেলার ডকসা পাড়া গ্রামের মোছাঃ লাইলী বেগমের জীবন কাহিনী।
০৫। সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন যে নারী। মোছাঃ লাইলী বেগম,পিতা-মরহুম খামির উদ্দীন,স্বামী-তোফাজ্জল হোসেন, মাতা-মোছাঃ মকছেদা বেগম, গ্রাম-ডকসা পাড়া,উপজেলা-বোদা-জেলা-পঞ্চগড়। লাইলী বেগম গত ২০/০৬/১৯৭৩ খ্রি: সালে জন্মগ্রহণ করেন। দারিদ্রতার কারনে নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। কৈশরে তাকে বিয়ের পিড়িতে বসতে হয়। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ী গিয়ে জানতে পারে তার স্বামী পালিত সন্তান। শ্বশুরবাড়ীর লোকজন সবসময় তাকে নির্যাতন ও অপমান করত। এমনকি গরম ভাতের মার তার গায়ে ঢেলে দিয়েছিল। নির্যাতনের মাত্রা বেরেগেলে একসময় বাবার বাড়ী চলে আসেন। সেখানে আর ডি আর এস এনজিও হতে (দশ হাজার) ১০,০০০/= টাকা লোন নিয়ে স্বামীকে কাচা মালের ব্যবসার কাজে লাগিয়ে দেন । তৎসংগে জনকল্যাণ মুলক কাজে অংশ গ্রহন করে বোদা সমাজ কল্যাণ ফেডারেশনে নির্বাচন করে পরপর ২বার জয়লাভ করেন। এমনকি তিনি স্থানীয় এনজিওতে বাইসাইকেল চালিয়ে সমিতির কিস্তী আদায় করে জীবন সংগ্রামে সফলতার মূখ দেখতে পান । ১৯৯৫ সালে আনসার ভিডিপির প্রশিক্ষন গ্রহন করে শ্রেষ্ট দলনেত্রীর পুরস্কার লাভ করেন। তিনি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দু দু বার নির্বাচনে সংরক্ষিত মহিলা আসনে বিজয়ী হন। তিনি ২০০৮/২০০৯ সালে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হন। বর্তমানেও তিনি উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top