সকল মেনু

খাসেরহাটে রসালো রসগোল্লা

৪০নিজস্ব প্রতিবেদক, নগরকন্ঠ.কম ১৪ মে :‘রসে ভরা রসগোল্লা’ একবার খাইলেই বারবার খাইতে মন চায়! এ অঞ্চলের ভোজন রসিকদের কাছে ঐতিহ্যের কারণে হোক বা স্বাদের কারণেই হোক বরিশালের মুলাদী উপজেলার খাসেরহাটে রসগোল্লা ছাড়া যেন ভোজন পুরোটাই অসমাপ্ত থেকে যায়।

এ রসগোল্লা শুধুমাত্র দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়- সুদূর চীন, আমেরিকা, ইউরোপে প্রবাসীদের মাধ্যমে চলে যাচ্ছে এ রসগোল্লা। বিদেশিদের কাছ থেকেও এ মিষ্টি সুনাম কুড়িয়েছে। প্রতিদিন মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে মুলাদীতে আসছে খাসেরহাটের মিষ্টির জন্য।

বরিশাল অঞ্চলে নামকরা গৌরনদীর দই-মিষ্টির পরে এর অবস্থান একটুও কম নয়। চাহিদা অনুযায়ী এ মিষ্টি তৈরি করা হয় বলে অনেক সময় ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় খাসেরহাটের দীপ সাহা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মিষ্টি পাওয়াটা।

খাসেরহাট বন্দর বাজারটি এক সময় ব্যাপক বড় ও জনপ্রিয় ছিলো, কালের বিবর্তনে এটি এখন ছোট। বিশেষ দিন (হাঁটবার) ছাড়া বন্দরে ব্যবসায়ও মন্থর গতি চলে এসেছে। তবে এখানকার দীপ সাহা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মিষ্টি আজও জনপ্রিয়।

কর্মচারীবিহীন পারিবারিক এ মিষ্টির ব্যবসায়ের কারণে ওই অঞ্চলে দুধের ব্যবসাটাও জমিয়ে রেখেছেন তারা। প্রতিদিন সকালে এ বন্দরে স্থানীয় ফার্মবিহীন গরুর দুধ নিয়ে আসেন গোয়লীরা। বাজারে হরেক রকম ক্রেতাদের মধ্যে কিছুটা দরদাম করেই পানির মিশ্রণবিহীন (স্থানীয় কৌশলে ঘনত্ব দেখে) দুধ কিনছে দীপ সাহা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার।

কখনো দুই মণ কখনো আড়াই মণ, আবার কখনো এর চেয়ে কম/বেশি কাঁচা দুধ ক্রয় করেন তারা। এ দুধ ক্রয়ের পর তাদের নিজেদের মিষ্টি তৈরির পাকের (রান্না) ঘরে নিয়ে আসা হয়। ছাকার পর কিছুটা সময় দুধ কাঠের চুলোয় জাল দিয়ে তারপর আবার ঠাণ্ডা করেন। আগে রেখে দেওয়া ছানা পানির সহায়তায় ঠাণ্ডা হওয়া দুধের ছানা কাটা হয়। পুরাতন ছানার পানি না হলে নতুন করে দুধের ছানা কাটা সম্ভব হয় না বলেই জানালেন মিষ্টির কারিগররা।

এরপর কাপড়ের মাধ্যমে দুধের পানি থেকে ছানাকে আলাদা করার জন্য ছাকা হয়। দীর্ঘ সময় ধরে পানি ছাকার কাজ শেষ হয়ে গেলে ছানা কিছুটা ঝরঝরে হয়ে ওঠে। এরপর ছানা দিয়ে চলে মিষ্টি তৈরির প্রক্রিয়া। তবে খালি ছানাও কিনতে পাওয়া যাবে এখানে। এর জন্য আগে থেকে বলে রাখতে হবে।

মিষ্টি তৈরির ক্ষেত্রে দুই কেজি বিশুদ্ধ ছানার জন্য ছোট চা-চামচের তিন চামচ চিনি, তিন আঙ্গুলের মাথায় এক চিমটি বেকিং সোডা নিয়ে হাফ কাপ পানি দিয়ে ছানার সঙ্গে ভালো একটি মিশ্রণ তৈরি করা হয়। তবে বেকিং সোডার পরিমাণ বেশি হলে মিষ্টিতে নানান ত্রুটিও দেখা দিতে পারে। তাই পরিমাণটা সঠিক হওয়া উচিত।

মিশ্রণের সময় দুই হাত ও পাত্র পরিষ্কার থাকাই ভালো। কারণ মিশ্রণে ময়লা থাকলে মিষ্টি ভেঙে যেতে পারে বলে জানালেন মিষ্টি কারিগররা। সাহা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের এ মিশ্রণ পাত্রটি বিশেষভাবে কাঠ দিয়ে তৈরি।

মিশ্রণ তৈরি হয়ে গেলে সাইজ অনুযায়ী বিভিন্ন আকারে ছানা গোলাকার আকৃতি করা হয়। পরবর্তীতে সেই গোলাকার ছানার টুকরোগুলো আট কেজি চিনির তৈরি সিরার মধ্যে মিনিট বিশেক জাল দেওয়া হয়। পুরো প্রক্রিয়ায় হাতের নৈপূণ্যতাই মূখ্য বিষয়।

হাতের নৈপূণ্যতার সঙ্গে নরম-সুস্বাদু ও ঐতিহ্যবাহী এ মিষ্টি তৈরি হয়ে যায়। আর এ মিষ্টি সর্বোচ্চ দুই থেকে তিন দিন খাওয়ার উপযোগী থাকে। তবে গরম অবস্থায় প্যাক করে অনত্র্য নিয়ে যাওয়ায় মিষ্টির আয়ুষ্কাল ভালো থাকে।

দীপ সাহার মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মালিক দুলাল চন্দ্র সাহা বলেন, পাঁচ থেকে শুরু করে ২০টাকা পর্যন্ত বিভিন্ন সাইজের মিষ্টি পাওয়া যায়। ছানার মিষ্টির পাশাপাশি খাঁটি ছানা ও ঘি পাওয়া যায়। প্রতি কেজি ছানার মূল্য চারশ’ত টাকা, আর ঘি প্রতি কেজির মূল্য এক হাজার থেকে ১২শ’ত টাকা। আর কারও বেশি পরিমাণে ছানার মিষ্টি প্রয়োজন হলে আগে থেকে বলে রাখা ভালো।

তিনি জানান, স্থানীয়রা ছাড়াও এ মিষ্টি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, প্রবাসী, বিদেশিদের কাছে ভালো সুনাম অর্জন করেছে। গোটা বরিশালের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাদের এ মিষ্টির কদর রয়েছে। তাই ব্যয় বাড়লেও মিষ্টির গুণগতমান ধরে রাখতে কোনো ধরনের ভেজালের ছোঁয়া লাগতে দেননি।

দাদা অনন্ত সাহা, তারপর বাবা নন্দ লাল সাহা আর এখন তারা ছয় ভাইয়ের মধ্যে সুভাস সাহা, দুলাল সাহা ও কৃষ্ণ চন্দ্র সাহা পর্যায়ক্রমে ঐতিহ্যবাহী এ মিষ্টির ব্যবসা ধরে রেখেছেন।

পারিবারিক এ ব্যবসায় কোনো শ্রমিক রাখছেন না তারা। বর্তমানে দুলাল চন্দ্র সাহা ও কৃষ্ণ চন্দ্র সাহা নিজেরাই এ মিষ্টি তৈরি ও বিক্রির কাজ করছেন। আর তাদের কাজে তাদেরই স্কুল-কলেজ পড়ুয়া সন্তানরা সহায়তা করছেন। তাই তারাও ইতোমধ্যে দক্ষ কারিগরের খেতাব পেয়েছেন।

দুলাল সাহা বলেন, যখন দেশে ছোট কাতিতে (টিনের ছোট জার) করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মিষ্টি বিক্রি হতো, ঠিক সেই আমল (আইয়ুব খানের) হতে তারা বরিশালের এ মুলাদী অঞ্চলে মিষ্টি বিক্রি করেছেন। যা তিনি বাবা-দাদাদের কাছ থেকে দেখেছেন। আর এ কাজে তখন ঘরের নারীরা সহায়তা করতেন।

তিনি মনে করেন তার দুই ভাইয়ের মৃত্যুর পর হয়তো বাপ-দাদার এ ব্যবসা এখানে শেষ হয়ে যাবে। হারিয়ে যাবে খাসেরহাটের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টির সুনাম।

যেভাবে যাবেন রসগোল্লার ঘরে
বরিশালের মুলাদী উপজেলার নয়াভাঙ্গুলি নদীর পাশেই খাসেরহাট বাজারের অবস্থান। নদীর ওপারে মেহেন্দীগঞ্জের কাজীরহাট থানাধীন এলাকা। পাকা-আধাপাকা দোকানঘরের খাসেরহাট বাজারের মধ্যখানে এ মিষ্টির দোকানের অবস্থান।

বরিশাল শহর থেকে সদর উপজেলার শায়েস্তাবাদ ও মেহেন্দীগঞ্জের ভাষানচর হয়ে যাওয়া যায় খাসেরহাট বাজারে। তবে এতে বাহন হিসেবে মোটরসাইকেল ও খেয়ার মাধ্যমে তিনটি নদী পার হতে হবে। এছাড়া বরিশালের নতুল্লাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে সরাসরি মুলাদীর উদ্দেশে যাওয়া যায়। এক্ষেত্রে বাসের হেলপারকে খাসেরহাটে নামিয়ে দেওয়ার কথা বলে রাখা ভালো।

অথবা নতুনবাজার বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসে করে বাবুগঞ্জের মীরগঞ্জ ফেরিঘাট গিয়ে খেয়া পার হয়ে ওপারে উঠতে হবে। ওপার থেকে বাস অথবা ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলে খাসেরহাট বাজারে যেতে পারেন। বাজার ও এর আশপাশের এলাকার মানুষকে জিজ্ঞাসা করলেই এক কথায় তারা দেখিয়ে দেবে রসগোল্লার ঘরের দিকে যাওয়ার পথের নির্দেশনা।
হটনিউজ২৪বিডি.কম/এআর

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top