সকল মেনু

পুড়ছে এখনো সুন্দরবন

11461942302খুলনা প্রতিনিধি : শুক্রবার সকাল পৌনে ৮টা। বাগেরহাট শহর থেকে মোটরসাইকেলে করে রওনা হই। মোড়েলগঞ্জের পানগুছি নদি ফেরিতে পার হয়ে শরণখোলার পহলানবাড়ী বাজার থেকে রাজাপুর। এরপর বনসংলগ্ন ভোলা নদি পার হয়ে এক কিলোমিটার পায়ে হেঁটে সুন্দরবনের ধানসাগর স্টেশনে ফরেস্ট অফিসে পৌঁছাই। তখন প্রচ- রোদ। ভাটার কারণে খালে পানি খুবই কম। অবশেষে মাছ শিকারের ডিঙ্গি নৌকায় চড়ে দুই ঘণ্টা চেষ্টার পর দুপুরে পৌঁছাই তুলাতলা এলাকায়।

সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, বিকেল পর্যন্ত সেখানে প্রায় চার কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কমপক্ষে ১২টি স্থানে আগুন জ্বলছে। বাতাসে আগুনের বিস্তৃতি তখনো বাড়ছে। প্রচ- দাবদাহ এবং ঘটনাস্থলের কাছাকাছি পানির উৎস না থাকায় আগুন নেভানো কঠিন হয়ে পড়ছে। বন বিভাগের পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিসের খুলনা-বাগেরহাট-মোড়েলগঞ্জ ও শরণখোলার চারটি ইউনিটের ৩২ জন কর্মী আগুন নেভাতে সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন। বিভিন্ন স্থানে আগুন দেওয়ার কারণে ফায়ার লাইন কেটে তা নিয়ন্ত্রণ করতেও তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। বনজীবীরা আগুন ছড়িয়ে পড়ায় দাবানলের আশঙ্কা করছেন।

গত ১৪ বছরে সুন্দরবনে ২২টি অগ্নিকা-ের মধ্যে এবারের অগ্নিকান্ডের ধরণ একেবারেই ভিন্ন বলে জানিয়েছে বন বিভাগ। বন কর্মকর্তারা বলছেন, ইতিপূর্বে বনের একটি বা দুটি স্থানে আগুন লাগলেও এবার দুর্বৃত্তরা সুপরিকল্পিতভাবে সুন্দরবনের ২৫ নম্বর কম্পার্টমেন্টের অন্তত ১০-১৫টি স্থানে আগুন দিয়েছে। এবার বনের একাধিক দুর্গম স্থানে একই সঙ্গে আগুন দেওয়ায় তা নেভানো দুঃসাধ্য হয়ে পড়ছে।

চাঁদপাই রেঞ্জের এসিএফ বেলায়েত হোসেন বলেন, দুর্বৃত্তরা এবার পরিকল্পিতভাবে বনের তুলাতলা এলাকার কয়েক কিলোমিটার জুড়ে বিক্ষিপ্তভাবে আগুন দিয়েছে। বেশ দূওে দূরে আগুন দেওয়ায় তা সম্পূর্ণ নেভাতে বেগ পেতে হচ্ছে। কিছু এলাকায় এখনো সামান্য আগুন এবং ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। আমরা আগুন সম্পূর্ণ নেভাতে কাজ করছি।

বনসংলগ্ন সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, আগুন এখনো জ্বলছে। আগুন লাগার ৪৮ ঘণ্টা পার হলেও তা নেভাতে পারেনি বন বিভাগ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।

বনজীবী সগির আকন, ফুল মিয়া কাজী, বাদল ফকির, বজলু হাওলাদার জানান, কমপক্ষে ৪ কিলোমিটার এলাকার ১০টি স্থানে আগুন জ্বলছে। কাছাকাছি পানি না থাকায় এবং বাতাস ও তীব্র দাবদাহের কারণে তা নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কষ্ট হচ্ছে। বৈরী এ পরিস্থিতিতে দাবানলের সৃষ্টি হতে পারে বলে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

বাগেরহাট ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক মো. মানিকুজ্জামান বলেন, আগুন নেভাতে বুধবার সন্ধ্যা থেকে খুলনা, বাগেরহাট, মোড়েলগঞ্জ ও শরণখোলা ফায়ার সার্ভিসের চারটি ইউনিট কাজ করছে। ‘তীব্র গরম এবং পানির উৎস্য দূরে হওয়ায় আগুন নেভাতে বেগ পেতে হচ্ছে।’

এবারের অগ্নিকা-কবলিত এলাকাটি বেশ দুর্গম, উল্লেখ করে তিনি জানান, ধানসাগর স্টেশনের ২৫ নম্বর কম্পার্টমেন্টের তুলাতলা এলাকায় আগুন নেভাতে তাদেরকে প্রায় ২ কিলোমিটার দূরের আড়ুয়াবয়াড় খাল থেকে পানি আনতে হচ্ছে। প্রচ- গরমে একনাগাড়ে কাজ করতে গিয়ে কর্মীরা ক্লান্ত ও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।

তিনি আরো বলেন, ‘এবার আগুনের বিস্তৃতি অনেক বেশি। বাতাসের কারণে এরইমধ্যে আগুন ওই এলাকার উত্তর ও দক্ষিণ দিকের কয়েকটি এলাকায় ছড়িয়েছে। ফলে আগুন নেভাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

ঘটনাস্থলটি বেশ দুর্গম হওয়ায় সেখানে মোবাইল নেটওয়ার্কও পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে আগুন নেভানোর কাজে নিয়োজিত দমকল কর্মীদের পক্ষে বন বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না।’

উল্টো পথে এসে বিভিন্ন স্থানে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা : র‌্যাব
এদিকে, সরেজমিন ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর শুক্রবার র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ান(র‌্যাব)- ৬ খুলনার কমান্ডিং অফিসার (সিও) খন্দকার রফিকুল ইসলাম জানান, ব্যক্তিস্বার্থে কতিপয় দুর্বৃত্ত বনে আগুন দেয়। এ নিয়ে মামলা করায় ক্ষুব্ধ হয়ে তারা প্রতিশোধ নিতে আবারও আগুন দেয়। সম্প্রতি ধানসাগর স্টেশনে বন রক্ষায় ওয়াচ টাওয়ার স্থাপনের কারণে সর্বশেষ (২৭-এপ্রিল) ওই দুর্বৃত্তরা উল্টো পথে নৌকায় করে বনের ভেতর দিয়ে এসে আধা কিলোমিটার পর পর ছয়/সাতটি স্থানে আাগুন দিয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। এ অপরাধীদের দমনে প্রয়োজনীয় সবরকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে তিনি আশা ব্যক্ত করেন।
দুই রেঞ্জেই পাশ পারমিট বন্ধ
শুক্রবার বন বিভাগের খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মো. জহির উদ্দিন আহমেদ ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর জানান, কিছু এলাকায় এখনো ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। তবে আগুন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কত বড় এলাকা জুড়ে আগুন ছড়িয়েছে বা কী ধরনের গাছপালা পুড়েছে, সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেননি তিনি। আগুন সম্পূর্ণ নিভে গেলেও ফায়ার সার্ভিসকে সুন্দরবন থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে না। বন বিভাগের সঙ্গে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরাও ওই এলাকায় পর্যবেক্ষণে থাকবে।

তিনি আরো জানান, দফায় দফায় সুন্দরবনে আগুন লাগার কারণে সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগের দুটি রেঞ্জে শরণখোলা এবং চাঁদপাইয়ে সব ধরনের পাশ পারমিট সাময়িকভাবে বন্ধ করে বিশেষ সতর্কতা জারি করা হয়েছে। তবে বাইরে থেকে আসা পর্যটকরা সুন্দরবনে প্রবেশ করতে পারবেন। সুন্দরবনের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে না আসা পর্যন্ত জেলে, বাওয়ালি, মৌয়াল ও সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বর্তমানে পাশ পারমিট নিয়ে যারা সুন্দরবনে অবস্থান করছে, তাদের দ্রুত সুন্দরবন থেকে বের হয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

এর আগে গত ২৭ মার্চ, ১৩ ও ১৮ এপ্রিল ধানসাগর স্টেশনের নাংলী ক্যাম্প এলাকায় আগুন লাগে। সে সময় বন বিভাগের পক্ষ থেকে তদন্ত করে স্থানীয় দুর্বৃত্তদের দায়ী করা হয়। ওই ঘটনায় দুটি মামলাও করে বনবিভাগ। তবে এখনো কোনো আসামি গ্রেপ্তার হয়নি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top